২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে ১৯৪৭ সালে এ অঞ্চল স্বাধীন হওয়ার পর, এমনকি একাত্তরে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও অর্ধশতাব্দীর বেশি হয়ে গেছে। এর মধ্যে কত কী ওলট-পালট হয়েছে। কিন্তু পাল্টায়নি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। স্বাধীনতার ২০ বছর পর ১৯৯১ সালে যখন দেশে প্রথম নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা হয় কেবল তখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে কারিকুলাম পুনর্বিন্যাস ও বাস্তবায়নের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নেয়া হয়। চার বছরের ব্যাপক আয়োজনের ফসল হিসেবে ১৯৯৬ সালে ৪৪টি বিষয়ের নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন এবং তার ভিত্তিতে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণীর নতুন বই রচনা, সম্পাদনার পর মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। এসব পাঠ্যপুস্তক ২০১৩ সাল পর্যন্ত চলেছে। আবারো একই প্রক্রিয়ায় ২০১২ সালে কারিকুলাম পরিমার্জন এবং তার ভিত্তিতে ২০১৩ সালে নতুন বই প্রকাশ পায়।
হ্যাঁ, এটি নিরেট সত্যি কথা যে, একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার ২৫ বছর পর বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে প্রথম এ দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষায় পরিপূর্ণ কারিকুলাম প্রণীত হয়। তার ভিত্তিতে রচিত ও মুদ্রিত চার কোটি প্রাথমিক ও দুই কোটি মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর জন্য ৩৪ কোটি পাঠ্যপুস্তক মুদ্রিত এবং বছরের প্রথম দিন দেশের সর্বত্র এসব বই শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছানো হয়। আরো উল্লেখযোগ্য যে, এ আমলে সর্বপ্রথম প্রাইমারি শিক্ষার্থীদের হাতে বই ‘বিনামূল্যে বিতরণ’ শুরু করা হয়। সেই সাথে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রীদের ‘শিক্ষা অবৈতনিক’ করা হয়। এমনকি বেগম খালেদা জিয়া তার শেষ শাসনামলে (২০০১-০৬) দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুরারোগ্য ব্যাধি নকল প্রবণতার কবর রচনা করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলে মিড-ডি মিল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন ধারার প্রবর্তন অপরিহার্য।
এর চমৎকার কার্যক্রমও গ্রহণ করেন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু ২০০৬ সালে তার বিদায়ের পর আজ পর্যন্ত এ কার্যক্রম আর আলোর মুখ দেখেনি। দুর্ভাগ্যজনক হলো- এত সব যুগান্তকারী কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও ২০০৬ সালের পরবর্তী বিগত ১৮ বছরে দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে এক চরম নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। শিক্ষানীতি প্রণয়নে হ-য-ব-র-ল, কারিকুলামে বারবার বিতর্কিত বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্তি ও সমালোচনায় পিছুটান, পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে দুর্নীতি এবং শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র নামধারী ক্যাডারদের দৌরাত্ম্য ও অস্ত্রের ঝনঝনানি, টেন্ডারবাজির টাকা ভাগাভাগিতে ছাত্রনেতা ও ভিসির মধ্যে প্রকাশ্য দ্ব›দ্ব আর সর্বত্র দলীয়করণের নোংরা সংস্কৃতি চালুর ফলে দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
কল্পনা করা যায় যে, একজন দলদাস যার বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি ছিল না, ছিল কেবল কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি পাস আর সাথে দলীয় আনুগত্য তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে পদটি কলঙ্কিত করা হয়। এত সবের মধ্যে আর যা-ই হোক অন্তত ‘শিক্ষা’ নামক বিষয়টি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পাঠ্যপুস্তকে কনটেন্টের চৌর্যবৃত্তি এবং উপস্থাপনায় ব্যক্তি পূজা ও পরিবার বন্দনা এমনভাবে স্থান পায়, যা শিশুদের কচিমন বিষিয়ে তোলে। সব মিলিয়ে বিগত দেড় যুগে দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় এক চরম স্থবিরতা নেমে আসে। বেগম খালেদা জিয়া তার দুই মেয়াদে দু’জন অসম্ভব উচ্চমানের সর্বোচ্চ শিক্ষিত বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও ড. ওসমান ফারুককে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে যেভাবে চমৎকার পুষ্পশোভিত শিক্ষাকুঞ্জ সাজিয়েছিলেন সেটি পরবর্তী ১৮ বছরে নোংরামির বুলডোজার চালিয়ে রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়। এসব জঞ্জাল সাফ করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুনরুদ্ধার না করা পর্যন্ত দেশের কোনো অগ্রগতি টেকসই হবে না। এ প্রেক্ষিতে একটিই কথা বলা যায়। তা হলো- মানুষ সৃষ্ট কোনো সমস্যা উত্তরণের ঊর্ধ্বে নয়, অসম্ভবও নয়।
সমস্যা সম্পর্কে ধারণা স্বচ্ছ থাকলে এবং ইচ্ছাশক্তি দৃঢ় হলে সব সমস্যা সমাধান করা যায়। প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগে এগোনো। দেশে যেসব স্বচ্ছ ধারণার শিক্ষা উদ্যোগী বিশিষ্টজনরা আছেন, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট চিন্তকরা আছেন তাদের নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। তারা পারেন দেশের জন্য একটি যুগোপযোগী ‘শিক্ষানীতি’ প্রণয়ন করতে। আমাদের প্রাইমারি শিক্ষা যা ইতোমধ্যে বাধ্যতামূলক ও সর্বজনীন আছে সেটি সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে খুব ভালো হবে। এতে দেশের সামগ্রিক শিক্ষার হার বাড়বে।
এরপর ঠিক করতে হবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কিভাবে যুগোপযোগীভাবে গড়ে তুলতে পারি। শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম উপাদন হলো ‘কারিকুলাম’। এটির প্রণয়ন দেশ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে বাধ্য। কারণ দেশে দেশে শিক্ষার বিষয় বিন্যাস ভিন্ন হতে পারে। তাই শিক্ষাদানের টুলস ও শিখন পদ্ধতি ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। এ কারণে দেশভেদে কারিকুলাম কাঠামো অবশ্যই ভিন্ন হবে। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন ধারার প্রবর্তন অপরিহার্য।
দেশীয় বিশেষজ্ঞরা যেভাবে আমাদের শিক্ষা স্তরগুলোয় কারিকুলাম প্রণয়ন করতে পারেন; তা একজন বিদেশী পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ প্রতিবার বিশ্বব্যাংক বা এডিবির কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠান দু’টির প্রেসক্রিপশনে কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়। এটি সম্পূর্ণ একটি অপচয়; বরং বিদেশী দাতা সংস্থার কোনো ঋণ না নিয়ে এনসিটিবি দেশের প্রথিতযশা কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদদের সহায়তায় নিজস্ব বিশেষজ্ঞ টিম দিয়ে কাজটি একটি চলমান প্রক্রিয়ায় করিয়ে নিতে পারে। তাতে জাতির কাঁধে বিদেশী ঋণের বোঝা আর চাপে না। ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘটা করে কারিকুলাম প্রণয়ন বা সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই।
পৃথিবীতে সংঘটিত পরিবর্তন অনুসারে চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রতি বছর প্রতিটি বিষয়ের কারিকুলাম পরিবর্তিত হবে। সে অনুসারে সংশ্লিষ্ট পাঠ্যপুস্তকেও পরিবর্তনটুকু সংযোজিত বা বিয়োজিত হয়ে যাবে। সুতরাং সাংবাৎসরিক পরিবর্তন যেহেতু সামান্য তাই প্রতি বছর পাঠ্যপুস্তক ছাপাতেও বিশেষ বেগ পেতে হবে না। বছরব্যাপী চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পাঠ্যপুস্তকের মুদ্রণ কাজ চলতে থাকলে সময়ের বহু আগে বই মুদ্রিত হয়ে দেশের আনাচে-কানাচে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যাবে। প্রতি বছর মুদ্রণকাজে যে জটিলতা হয়, বই পৌঁছাতে দেরি হয় তার মূল কারণ এনসিটিবি ও মুদ্রণকারীদের মধ্যে সমস্যা। বিভিন্ন কারণে এনসিটিবি পাণ্ডুলিপি সরবরাহ করতে দেরি করে।
আবার মুদ্রণকারীরা বই ছাপার কাজ ফেলে রেখে নগদ আয়ের কাজ ক্যালেন্ডার, ডায়রি, নোটবই প্রভৃতি ছাপায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রায় এক হাজারের মতো মুদ্রণকারীর সাথে এনসিটিবি বছরের শুরুতে বসে সময়মতো বই মুদ্রণ ও বণ্টনের বিষয় ঠিক করে নিতে পারে। পাণ্ডুলিপি সরবরাহে যদি দেরি হয় তবে সে বছর বইতে আর সংশোধন বা পরিমার্জন আনার প্রয়োজন নেই। আগের পাণ্ডুলিপি দিয়ে যথাসময়ে বই ছাপা হোক। সময় নিয়ে পরিমার্জন করে পরের বছর পরিমার্জিত পাণ্ডুলিপিতে বই মুদ্রিত হবে। মুদ্রণকারীদের বিলম্ব প্রবণতাও বছরের শুরু থেকে নজরদারি দ্বারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। প্রতি জেলায় এডিসি (শিক্ষা) মনিটর করবেন প্রতিদিন তার জেলায় কত বই পৌঁছাল। কত বই বাকি। দিন শেষে এনসিটিবি চেয়ারম্যানকে তিনি জানাবেন। এনসিটিবি সে অনুসারে ব্যবস্থা নেবে। এটি হেলাফেলার কাজ নয়।
৩৫-৪০ কোটি বই ছেপে সারা দেশের প্রত্যন্ত কোণে পৌঁছানো এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। এনসিটিবির কাজ শুধু বই ছাপানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি বিষয়ের পাণ্ডুলিপি রচনায় সঠিক লেখক নির্বাচন, রচনার পর পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা, মূল্যায়ন বা সংশোধন এবং সবশেষে মুদ্রণ। মুদ্রণকালে বানান সংশোধন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর যেকোনো ধাপে অবহেলা ভুলের জন্ম দেয়, যা পরে পত্রিকার পাতায় সমালোচনার ঝড় তোলে। সুতরাং এনসিটিবি যদি চোখ-কান খোলা রেখে একটু দায়িত্বশীলতার সাথে পুরো কর্মযজ্ঞ নিয়ন্ত্রণ করে আর মুদ্রণকারীরাও যদি যথাযথ দায়িত্ববোধের পরিচয় দেন; তাহলে শিক্ষার্থীদের হাতে সময়ের আগে চমৎকার পাঠ্যপুস্তক পৌঁছানো অবশ্যই সম্ভব।
তবে কথা আছে। তিন যুগ আগে এনসিটিবির যে ৩০০ লোকের জনবল আছে তা দিয়ে চলবে না। পৃথিবীর কোথায় জ্ঞানের জগতে এবং শিক্ষাক্রমে কী পরিবর্তন আসছে, তা পর্যবেক্ষণ করে সেই আলোকে নিখুঁত গবেষণা দ্বারা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বা কারিকুলামে কিভাবে এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে, তার জন্য প্রয়োজন একগুচ্ছছ প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ দল। এনসিটিবির কারিকুলাম শাখায় সৃষ্টি করতে হবে একটি গবেষণা সেল। তাতে থাকতে হবে প্রয়োজনীয় সব উপকরণ ও সরঞ্জাম। এনসিটিবিতে বিগত দীর্ঘ সময়ে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বিগত সরকারের দুর্বিনীত লালসার শিকার হয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে এনসিটিবি থেকে ছিটকে গেছেন দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তাদের আবার ফেরত এনে এনসিটিবিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। তাহলে কেবল সমৃদ্ধ কারিকুলাম আর কাক্সিক্ষত শিখন সামগ্রী পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে।
শিক্ষার্থীদের কেবল শিখালে হবে না। প্রয়োজন তাদের শিক্ষা লাভের মূল্যায়নও। এখানে আমাদের প্রস্তাব থাকবে ব্যাপক মোড় পরিবর্তনের। আমরা শিক্ষা দান কেন করি? একজন শিক্ষার্থীকে আলোকিত করার জন্যই তো; অর্থাৎ জীবন চলার পথ সুগম করতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে। সুতরাং সে উদ্দেশ্য কতটুকু হলো সেটি যাচাই করতে প্রয়োজন মূল্যায়ন। এ জন্য বছরব্যাপী একটির পর একটি পরীক্ষা নিয়ে একজন শিশু বা কিশোরকে ব্যস্ত করে তোলা হয়। মনোরঞ্জনের ন্যূনতম সময় তারা পায় না। হতে পারে না যে, অন্তত প্রাইমারি শিক্ষা স্তর পর্যন্ত কোনো প্রচলিত শ্রেণী-পরীক্ষাই থাকবে না।
হ্যাঁ পারে, পৃথিবীর বহু দেশে তা আছে। শেখানো এবং শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক কর্তৃক তার মূল্যায়ন দৈনিক স্কুলে হয়ে যায়। শিক্ষার্থী বাড়ি ফিরে কোনো পড়ালেখা করবে না। সর্বোচ্চ কোনো অ্যাসাইনমেন্ট দিলে শুধু তা করবে। বাকি সময় খেলাধুলা আর এন্টারটেইনমেন্ট। ক্লাস থ্রি, ফোর বা ফাইভের অ্যাইনমেন্ট হিসেবে কবিতা, নাটিকা অথবা গত ভ্যাকেশনে বেড়ানোর উপভোগ, এমনকি রাস্তায় চলতে কুকুর, বিড়াল, সাপ, কাঠবিড়ালি বা শিয়াল দেখলে কী করবে, তা লিখতে দেয়। আমাদের দেশ হলে বলবে কী লাভ, বাবা-মা লিখে দেবে। আরে ভাই ওসব ছেলেমেয়ে যা লিখবে বাবা-মা আরো দু-একবার জন্ম নিয়ে এলেও তেমন মজা করে লিখতে পারবে না। প্রতিদিনের পড়ালেখা কাজকর্মের মূল্যায়ন-গ্রেড সপ্তাহ শেষে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয় অভিভাবককে। এভাবে মাসের পর মাস হয়ে বছরের শ্রেণিভিত্তিক মূল্যায়ন (এবিসি) করে শিক্ষার্থী পরের ক্লাসে উন্নীত হবে কোনো ঢাকঢোল, হইচই ছাড়া। কী অসুবিধা এমন পদ্ধতি আমাদের দেশে? কোনো সমস্যা নেই। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যা করে দিয়ে গেছেন গত শতাব্দীতে তাই মেনেই আমাদের জি এক্স স্পেস বিজ্ঞানের যুগেও চলতে হবে? মোটেও না। প্রাইমারি স্তরের শিক্ষা শেষে সেকেন্ডারিতেও একই ধারায় চলবে। তবে এখানে শ্রেণিভিত্তিক মূল্যায়নের পাশাপাশি শ্রেণী-পরীক্ষাও থাকবে। দুটো মিলে এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে উত্তরণ চলবে। কোনো মার্কিং সিস্টেম থাকবে না, গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন হবে। কোনো ফেল থাকবে না।
কেউ খারাপ করলে শ্রেণিশিক্ষক তাদের জন্য পৃথক শিক্ষায়ন ক্লাস নেবেন এবং ক্ষতিপূরণ সারিয়ে পরের ক্লাসে উতরে দেবেন। সেকেন্ডারি স্তরের ক্লাস টেন বা একাদশ শেষে শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসিতে একটি লিখিত পরীক্ষা হবে। ওই পরীক্ষার ফল এবং সেকেন্ডারি স্তরের চার-পাঁচ বছরের ক্রমবর্ধমান সিবিএ মিলে সামগ্রিক গ্রেড নির্ধারণ হবে এসএসসিতে। যদি আমরা এখনকার মতো এইচএসসি পদ্ধতিও রাখি তবে সেখানেও অনুরূপ পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হবে। তবে এইচএসসিকে মোটামুটি প্রি-ইউনিভার্সিটি প্রস্তুতি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অর্থাৎ উচ্চ শিক্ষা সীমিত করতে হবে। সবার জন্য উচ্চ শিক্ষা উন্মুক্ত রাখলে ব্যাপকভাবে জাতীয় অপচয় ঘটে। তাই এইচএসসি পাস করার পর অনেকে বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে কারিগরি বা ট্রেড শিক্ষা নিয়ে সংশ্লিষ্ট পেশায় আত্মনিয়োগ করতে পারেন অথবা উদ্যোগী হয়ে কেউ উদ্যোক্তার ভূমিকায়ও নামতে পারেন। কৃষি খামার, মৎস্য খামার, পোলট্রি, ডেইরি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখতে পারেন। উচ্চ শিক্ষায় দীর্ঘ সময় ব্যয় করে সীমিত উপার্জনের চাকরি খোঁজার পরিবর্তে এভাবে যেমনি নিজেকে ও পরিবারকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিকেও সমৃদ্ধ করতে পারেন। সীমিত সংখ্যক অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীকে কেবল উচ্চশিক্ষায় অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দেয়া উচিত যারা জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষায়িত ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা বা কারিগরি বা ট্রেড শিক্ষায় এসব ইনট্যাক খুব পরিকল্পিত ও সুসমন্বিত পন্থায় নির্ধারণ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। তা হলে কেবল জাতীয় অপচয় রোধ করা ও অগ্রগতি নিশ্চিত করা যেতে পারে।
আমাদের জাতীয় জীবনে শিক্ষা ক্ষেত্রে সবচেয়ে হতাশার জায়গাটি সম্ভবত সর্ব পর্যায়ে শিক্ষক স্বল্পতা ও উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করলে কেউ শিক্ষক হয়ে যান না। কারণ শিক্ষকতা কোনো পেশার পদবি নয়। এটি এক নিখাদ আদর্শের নাম, এক মহান প্রতিষ্ঠান যেখানে মানুষ শেখে আদর্শ, নীতিহীনতা নয়। শিক্ষক শেখান, শাসন আবার প্রয়োজনে বুকে টেনে নেন। তাই তো শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু কই সে কারিগর? বরং আজ তো সমাজে শিক্ষক যেন এক বিরল প্রজাতি। এই তো দেখুন না বেশ কিছু দিন আগে পত্রিকার পাতায় ওঠা এক সত্যি ঘটনা। এ ঢাকা শহরেরই এক স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কচি শিক্ষার্থী তার শ্রেণিশিক্ষকের বাসায় কোচিংয়ে যেত। কী কারণে যেন তার কোচিংয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হলো। ব্যাস, আর যায় কই। শিক্ষক তাকে ডেকে নিয়ে শাসালেন, তিনি তাকে দেখে নেবেন। যথারীতি দেখে নিলেনও। ছেলেটি তার বিষয়ের পরীক্ষায় ফেল করল। বাবা-মা দেখলেন হঠাৎ করে ছেলেটি কেমন যেন বদলে গেল। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে। স্কুলেও যায় না। এক দিন স্কুলের কথা বলে বেরিয়ে গেল। আর বাসায় ফিরল না। বহু খোঁজাখুঁজির পর তার নিথর দেহটি পাওয়া গেল শহরের দূর প্রান্তে এক ব্রিজের নিচে। এ-জাতীয় শিক্ষক নামধারীর খবর পত্রিকার পাতায় মাঝে মধ্যে দেখা যায়। না। শিক্ষা কোনো পণ্য নয়। আর শিক্ষকও কোনো ব্যবসায়ী নন। শিক্ষকের কিছু মৌলিক গুণ থাকা প্রয়োজন। জন্মগতভাবে সেসব গুণ না থাকলেও ক্লাসে প্রবেশের আগে তাকে এসব গুণ রপ্ত করে নিতে হয় কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। কোনো কোনো দেশে আবার শিক্ষকতা পেশায় যেতে যারা ইচ্ছুক তাদের শিক্ষা জীবনে প্রি-টিচিং বিষয় নিয়ে পড়ার ব্যবস্থাও থাকে। মনে রাখতে হবে, একজন সফল শিক্ষক তিনি যিনি আগে থেকে ক্লাসের প্রস্তুতি নেন। এ ছাড়া বন্ধুবৎসলভাবে ক্লাসটি কিভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে সহজবোধ্য ও প্রাণবন্ত করে তুলবেন মনের কল্পনায় তার ছক সাজিয়ে নেন। তবে সবটা শিক্ষকের কাছ থেকে আশা করব তাও ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, একজন শিক্ষককে শিক্ষাদানে মনোযোগী করতে চাইলে তার বেতন কাঠামো আর আর্থিক সুবিধাও হতে হবে সম্মানজনক ও সন্তোষজনক। পৃথিবীর অনেক দেশে শিক্ষকরা সর্বোচ্চ আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। আমরাও তা করতে পারি।
সব কথার শেষ কথা, আমরা এক অপার সম্ভাবনাময় জাতি। বহুবার আমরা তা প্রমাণ করেছি। সুতরাং অনাগত ভবিষ্যতে কোনো এক নিপুণ হাতের পরিকল্পনায় ও উদ্যোগে হয়তো আজকের শ্রীহীন শিক্ষা উদ্যানে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে, এ আশা করাই যায়। তাই বলছিলাম আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন ধারার প্রবর্তন অপরিহার্য।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড
কার্টেসী: নয়া দিগন্ত
Discussion about this post