অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
পিরোজপুরের সাবেক এমপি এ কে এম এ আউয়াল ও তার স্ত্রীর জামিন খারিজের পর জেলা ও দায়রা জজকে তাৎক্ষণিক বদলির ঘটনায় দিনভর সুপ্রিম কোর্টসহ অন্যান্য আদালত অঙ্গণে বিচারসংশ্লিষ্টদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তাৎক্ষণিকভাবে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন বেশ কয়েকজন আইনজীবী। এরপর সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে নিজের দায় স্বীকার করেন আইনমন্ত্রী।
এর আগে গতকাল ‘আইনমন্ত্রীর নির্দেশেই পিরোজপুরে বিচারককে বদলি!’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী মুলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে অ্যানালাইসিস বিডি। তারপর থেকে আইনমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে তোড়জোড় শুরু হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্দেশেই বিচারক আব্দুল মান্নানকে বদলি করা হয়েছে। আর তাকে বদলির মূল কারণ হলো দুর্নীতিবাজ আওয়াল ও তার স্ত্রীর জামিন বাতিল করা। আজ আইনমন্ত্রীর দায় স্বীকারের মাধ্যমে প্রতিবেদনটি সত্য হলো।
এ ঘটনার জন্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের পদত্যাগ দাবি করেছেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ অন্যরা।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, কোনও যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়াই তাদেরকে দুর্নীতির মামলায় জামিন দেওয়া হয়। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে, মঙ্গলবার (৩ মার্চ) আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং এরপরই জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মান্নানকে প্রত্যাহার করা হয়। ওই ঘটনা স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপের শামিল। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অযাচিতভাবে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্যের জামিন নিশ্চিত করার জন্য পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্দুল মান্নানকে বদলি করেন। জেলা ও দায়রা জজ বদলির কারণে সুপ্রিম কো্র্টের (অনুমতির) কোনও তোয়াক্কা করা হয়নি। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্যের জামিন না মঞ্জুর করার কারণে পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজকে আইন মন্ত্রণালয়ের আদেশের মাধ্যমে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এরপর বুধবার বিকালে সচিবালয়ে নিজ দফতরে তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনে আসেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, সাবেক এমপি এ কে এম এ আউয়ালের জামিনের সময় জেলা ও দায়রা জজ মো. আবদুল মান্নান অত্যন্ত অশালীন ও রূঢ় ব্যবহার করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ওই বিচারককে স্ট্যান্ড রিলিজ (তাৎক্ষণিক বদলি) এবং পরে আউয়ালকে স্ত্রীসহ জামিন দেয়া হয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, সেই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে এমন একটা অবস্থা দাঁড়ায়, যেখানে বারের সবাই আদালত বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি রাস্তায় গণ্ডগোল চলছিল। রাস্তায় লোকজন বেরিয়ে গিয়েছিল। সেটাকে কন্ট্রোল করার জন্য তাকে (বিচারক) সেখান থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে আদেশ দেয়া হয়।
এদিকে পিরোজপুর সদরের সাবেক এমপি আউয়াল ও তার স্ত্রীর জামিন খারিজের পর পিরোজপুর জেলা জজ আবদুল মান্নানকে তাৎক্ষণিক বদলির আদেশ কেন অবৈধ হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। সংশ্লিষ্টদের এই রুলের জবাব দিতে বলা হলেছে। রুল জারির আগে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এএফ হাসান আরিফের মতামত শোনেন আদালত। এরপর স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার সকালে পিরোজপুরের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল তিনটি মামলায় এবং তার স্ত্রী লায়লা পারভীন একটি মামলায় পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। দুপুরে শুনানি শেষে বিচারক মো. আবদুল মান্নান জামিন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
কারাগারে পাঠানোর আদেশের পর আউয়াল ও লায়লা পারভীনের আইনজীবী আদালতে তাদের অসুস্থতার চিকিৎসা প্রতিবেদনসহ হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা ও ডিভিশন দেয়ার আবেদন করেন। বিকাল পৌনে ৩টার দিকে বিচারক ডিভিশনসহ হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এর কিছুক্ষণ পর জেলা ও দায়রা জজ মো. আবদুল মান্নানকে বদলির চিঠি পাঠানো হয়। এরপর তিনি যুগ্ম ও জেলা জজ নাহিদ নাসরিনের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে আউয়াল ও লায়লা পারভীনের আইনজীবীরা ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ নাহিদ নাসরিনের কাছে পুনরায় জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিকাল ৪টার দিকে বিচারক তাদের দুই মাসের জামিন দেন।
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের বরিশাল সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আলী আকবর বাদী হয়ে আউয়ালের বিরুদ্ধে খাসজমিতে ভবন নির্মাণ, অর্পিত সম্পত্তি ও পুকুর দখলের অভিযোগে তিনটি মামলা করেন। একটি মামলায় আউয়ালের সঙ্গে তার স্ত্রী পিরোজপুর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী লায়লা পারভীনকেও আসামি করা হয়েছে।
গত ৭ জানুয়ারি আউয়াল ও লায়লা পারভীন হাইকোর্ট থেকে আট সপ্তাহের অন্তর্বর্তী জামিন নেন। মঙ্গলবার ওই জামিনের মেয়াদ শেষ হলে তারা পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন।