অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অধিকাংশ এজেন্টকে ভোটের আগ মুহুর্তে সাদা পোশাকে পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে আবার ভোটশেষে ছেড়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। কাউকে ভোটের আগের রাতে, কাউকে ভোটের দিন ভোরে বাড়ি থেকে, কাউকে আবার সকালে কেন্দ্রের ভেতর ও বাইর থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ভোটের পরদিন বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজখবর করে এবং বিএনপির নেতা ও উধাও হয়ে যাওয়া এজেন্টদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
এমন অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলোর প্রতিবেদকরা। তবে বেশির ভাগই এখনো আতঙ্কে আছেন, নাম প্রকাশ করে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে ভয় পাচ্ছেন।
বিএনপির প্রার্থীর মিডিয়া সেলের প্রধান মাজহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার এড়াতে এজেন্টদের বাড়িতে না থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তাতেও লাভ হয়নি। অনেককে কেন্দ্রের ভেতর বুথ থেকেও সাদাপোশাকের পুলিশ বা ডিবি তুলে নিয়ে গেছে।
তুলে নিয়ে গোপন স্থানে রেখে ভোট শেষ হওয়ার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এমন ৪২ জন সম্পর্কে জানা গেছে, যাঁরা বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট বা কেন্দ্র কমিটির সদস্য ছিলেন।
তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আঞ্জুমান হেদায়েতুল উম্মত কেন্দ্রের এজেন্ট হাবীবুর রহমান, টিডিএইচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের এজেন্ট ফারুক হোসেন, ধীরাশ্রম জি কে আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের এজেন্ট সেলিম রেজা, সাহারা খাতুন কিন্ডারগার্টেন কেন্দ্রের এজেন্ট মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম, ধূমকেতু স্কুল কেন্দ্রের এজেন্ট আবদুল হামিদ, শ্রমকল্যাণ কেন্দ্র থেকে সাবেক পৌর কমিশনার শরিফ মিয়া, শরিফপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে মনির হোসেন, টঙ্গী থানা ছাত্রদলের সহসভাপতি শাহাব উদ্দিন, আমবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে শ্রমিক দলের নেতা বজলুর রহমান, পুবাইল রোমানিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্র থেকে খোরশেদ মিয়া, সাবেক কাশিমপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল আজিজ মাস্টার; ধূমকেতু কেন্দ্র থেকে শাহাব উদ্দিন, ক্যারিয়ার লাইফ স্কুল কেন্দ্রের আবদুল কাদির, ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের আহম্মদ, ১৫ নম্বর ওয়ার্ড ভোগড়া মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে গিয়াস উদ্দিন, টঙ্গী কিন্ডারগার্টেন কেন্দ্র থেকে সোহাগ প্রমুখ।
ভোটের দিন সকালে টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রবেশের সময় আটক করা হয় বিএনপির প্রার্থীর এজেন্ট আলমগীর হোসেনকে। একইভাবে আরিচপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র কমিটির সদস্য কাজী শাহীন, বনমালা এলাকা থেকে ছাত্রদলের নেতা রাজন ও বিএনপির কর্মী জাকির এবং ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক কাজী নজরুলকে আটক করা হয়।
টঙ্গী থানা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম ও শিমুলতলী কেন্দ্রের প্রধান এজেন্ট মোতালেব, মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা কেন্দ্রের এজেন্ট মো. মুন্নাকে ভোটের আগের সন্ধ্যায় বিলাসপুর বটতলা থেকে আটক করা হয়। ভোট শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর মুন্নাসহ ছয়জনকে কাপাসিয়া রোডের এক জায়গায় নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
৩১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আইনজীবী হাসানুজ্জামান, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের আমির হোসেন, তৈজউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রর এজেন্ট আবু বকর সিদ্দিককে ভোট শুরুর পর কেন্দ্র থেকে ডেকে নিয়ে আটক করা হয়। পরে অনেক রাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তুলে নেওয়া ও ফেরার গল্প
৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের গাছা কলমেশ্বর আদর্শ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভেতর থেকে ভোটের দিন দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ধানের শীষের এজেন্ট মোহাম্মদ ইদ্রিছ খানকে তুলে নেন সাদাপোশাকের একদল ব্যক্তি।
ইদ্রিছ খান প্রথম আলোকে বলেন, ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে চার ব্যক্তি কথা আছে বলে তাঁকে ঘরের বাইরে আসতে বলেন। তিনি বাইরে গেলে একজন এসে তাঁর বাঁ হাত ধরেন। আরেকজন কাঁধে ধরে হাঁটতে বলেন। এ সময় তিনি জানতে চান, ‘ভাই, কোনো সমস্যা?’ জবাবে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘সমস্যা না, আপনাকে হেল্প করছি। নিরাপদে সরিয়ে দিচ্ছি।’
পরে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটি হাইয়েস মাইক্রোবাসে তাঁকে তোলা হয় এবং একটি লাঠি দিয়ে কয়েকটি আঘাত করা হয়। চান্দনা চৌরাস্তা পুলিশ বক্সের কাছে এলে তাঁকে নামিয়ে একই ধরনের আরেকটি গাড়িতে তোলা হয়। পরে তাঁকে জেলা পুলিশ লাইনের একটি বড় কক্ষে নিয়ে রাখা হয়।
ইদ্রিছের ভাষ্য, সেখানে তাঁর আগে নিয়ে যাওয়া হয় ৩৬ জনকে। তিনি ৩৭ নম্বর। তারপর আরও ৫ জনকে সেখানে নেওয়া হয়। ওই কক্ষে মোট ৪২ জন ছিলেন বলে ইদ্রিছের দাবি।
অবশ্য গাজীপুর পুলিশ লাইনের আবাসিক পরিদর্শক (আরআই) আবুল কালাম আজাদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ লাইনে এমন কাউকে আটক করে রাখা হয়েছিল কি না, তাঁর জানা নেই। তিনি ভোটের দায়িত্ব পালনে বাইরে ছিলেন।
ইদ্রিছ খান প্রথম আলোকে বলেন, বিকেল সাড়ে চারটার দিকে একজন এসে বললেন, ‘আপনারা চিন্তা করবেন না। সবাইকে একটু দূরে নিয়ে ছেড়ে দেব।’ ইদ্রিস বলেন, ‘এরই মধ্যে সাত-আটটি বড় মাইক্রোবাস গাড়ি আনা হলো। একটা গাড়িতে ছিলাম আমরা ছয়জন এবং ডিবি পুলিশ ছিল চারজন। আমাদের গাড়ির পেছনের সিটে বসানো হলো। আমাদের গাড়িটা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সালনা ব্রিজ অতিক্রম করার পর বাম পাশে একটি সিএনজি স্টেশনে নিয়ে গাড়িতে গ্যাস নেওয়া হচ্ছিল। ডিবি পুলিশ চালককে ৭০০ টাকার গ্যাস নিতে বলল। কিন্তু দূরের যাত্রা হওয়ায় চালক গ্যাস নিল ১২০০ টাকার। অতিরিক্ত ৫০০ টাকার গ্যাস নেওয়ায় চালকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে পুলিশ এবং ৫০০ টাকা চালককে দিতে বলে। কিন্তু চালক জানায়, তার কাছে কোনো টাকা নেই। পরে পেছনে থাকা আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে গ্যাস বিল দেওয়া হয়।’
ইদ্রিছ বলেন, সন্ধ্যায় তাঁদের তিনজনকে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার বগমারা এলাকায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে রাতে বাসায় ফেরেন। কাশিমপুরের আবদুল আজিজ মাস্টারসহ বাকি তিনজনকে নিয়ে ভালুকার দিকে চলে যায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন-অর রশিদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির কোনো এজেন্টকে আটক বা তুলে নেওয়ার কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। কারও বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগ থাকলে তো পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে। আসামি ধরে নিয়ে ছেড়ে দেব কেন?’
বাড়ি থেকে তোলার গল্প
ভোটের দিন সকাল সাতটার দিকে উত্তর ধীরাশ্রমের বাসা থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায় তরুণ আইনজীবী সেলিম রেজাকে। তিনি ধানের শীষের একজন এজেন্ট। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এমন সময় পুলিশ এসে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে তাঁকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে পুলিশ লাইনে নেওয়া হয়। মঙ্গলবার বিকেল চারটার পর তিনিসহ নয়জনকে একটি গাড়িতে তুলে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার পরিষদ রোডে নামিয়ে দেওয়া হয়।
সেলিম রেজা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ওরা যখন রাস্তায় নামিয়ে দেয়, তখন তাঁর কাছে টাকা ছিল না। বাসায় ফোন করলে বিকাশে এক হাজার টাকা নিয়ে তারপর তিনি রাতে বাড়ি ফেরেন।
কারাগারে পাওয়া গেছে যাঁদের
ভোটের আগের দিন সন্ধ্যায় শহরের ধীরাশ্রম এলাকা থেকে ছয়জনকে তুলে নিয়ে যায় সাদাপোশাকের পুলিশ। তাঁরা হলেন আনোয়ার হোসেন, কবির হোসেন, মজিবুর, হেলেন বাদশা, আলমগীর ও মোশাররফ বাদশা। একই সময় সামন্তপুর এলাকা থেকে আমির, ইকবালসহ চারজনকে তুলে নেওয়া হয়। গতকাল বুধবার তাঁদের সন্ধান পাওয়া গেছে যে তাঁরা ঢাকার কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। তথ্যসূত্র: প্রথম আলো।