হঠাৎ বদলে গেছে তিন সিটির চিত্র। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পরিবেশ। বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার নিয়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক। সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে উত্তাপ এখন ভোটের মাঠে। কোথাও কোথাও সংঘর্ষও হয়েছে।
রোকনুজ্জামান পিয়াস ও ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে জানান, ছোটখাটো কিছু অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ ছাড়া একপ্রকার শান্তই ছিল সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরিবেশ। কিন্তু হঠাৎ করেই পাল্টে গেছে চিত্র।
গতকাল উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নির্বাচনী মাঠ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকাণ্ড উত্তেজনা ছড়িয়েছে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। তাদের দুই কর্মীকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের অস্বীকার উত্তেজনার বাড়তি রসদ যুগিয়েছে। প্রতিবাদে নামেন বিএনপির মেয়রপ্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। নেতাকর্মী ও সমর্থক নিয়ে বসে পড়েন উপ-পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের সামনে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তুমুল বিতণ্ডা হয় তার। তবে আরিফের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান বলছেন, এটা বিএনপির নাটক। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করাসহ নানা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তারা ভিত্তিহীন এসব অভিযোগ করছে। এসব উত্তেজনা শুধু মেয়র প্রার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বিস্তৃতি পেয়েছে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যেই। এরইমধ্যে বিভিন্ন কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে একাধিক সংঘর্ষ হয়েছে।
গতকাল ভোরের দিকে দক্ষিণ সুরমা থানার ঝালোপাড়া এলাকার ধানের শীষের দুই সমর্থককে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ওই দুইকর্মীর একজন সিটি করপোরেশনের একটি পাবলিক টয়লেটের কর্মচারী রাসেল (৩৩)। অপরজন সুমন আহমেদ। রাসেলের শ্যালক সাকিরুল ইসলামের অভিযোগ সাদা পোশাকের পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তারা নিজেদের দুক্ষিণ সুরমা থানার পুলিশ পরিচয় দেয়। পরে রাসেলের স্বজনরা থানায় খোঁজ নিতে গেলে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করে। এ খবর দ্রুত বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তারাও থানায় ভিড় জমান। পরে তাদের জানানো হয়, আটককৃতদের কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এ তথ্যের ভিত্তিতে ধানের শীষের কর্মী-সমর্থকরা কোতোয়ালি থানায় যায়। কিন্তু এ থানার পুলিশ কর্মকর্তারাও অস্বীকার করেন। স্বজনরা ডিসি অফিসে খোঁজ নেন। কিন্তু বরাবরের মতোই অস্বীকার করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এরইমধ্যে খবর পৌঁছে যায় খোজারখোলা এলাকায় গণসংযোগে থাকা বিএনপির প্রার্থী সদ্য সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে। ওই সময় তার সঙ্গে গণসংযোগে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস। দলীয় সমর্থকের গ্রেপ্তারের কথা শুনে আরিফ তার দলবল নিয়ে চলে যান উপ-পুলিশ কার্যালয়ের সামনে। সেখানে তিনি অবস্থান নেন। দুপুর দেড়টার দিকে রাস্তার ওপর বসে পড়েন। এ সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন আরিফুল হক। কিন্তু বরাবরের মতোই গ্রেপ্তারের বিষয়টি তারা অস্বীকার করেন। পরে তিনি পুলিশকে জানিয়ে দেন, দুই কর্মীর সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে একচুলও নড়বেন না। এ সময় মেয়র প্রার্থী আরিফ বলেন, গতকাল রাতে তাদের ধরে নিয়ে আসছে। তিনি বলেন, ধরে নিয়ে আসতে পারে, কিন্তু স্বীকার তো করতে হবে। বলতে হবে যে, তাকে কেন ধরেছে। কিন্তু তারা স্বীকারই করছে না। অভিযোগ থাকলে তাকে কোর্টে দেবেন। কিন্তু কোনোকিছুই বলছে না।
তিনি বলেন, যেখানে কোর্ট থেকে নির্দেশনা দেয়া আছে নির্বাচনকালীন কোনো মামলার আসামি ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না। সে একজন শ্রমিক। হেলপার। শুধুমাত্র আমার সমর্থক হওয়া তাকে ধরে নিয়ে গেছে। আরিফ বলেন, সিলেটে সুন্দর পরিবেশ, নির্বাচন উপলক্ষে মানুষের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা বিরাজ করছে। কিন্তু সেই পরিবেশ তারা নষ্ট করছে। এটা কেন?
এ সময় সেখানে হাজির হন দক্ষিণ সুরমা জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. আজবাহার আলী সেখ। তিনি বলেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ফেলে তিনি এসেছেন। আরিফ তার পরিচয় জানতে চান। পরিচয় দিলে তার কাছেও একই বক্তব্য উপস্থাপন করেন সাবেক এই মেয়র। ডিসিও এ সময় কাউকে ধরা হয়নি বলে জানান। আরিফ বলেন, তার কাছে ভিডিও ফুটেজ আছে। এর কিছুক্ষণ পর সেখানে হাজিন হন শাহপরাণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আকতার হোসেন। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তিনি বলেন, আটক দু’জনের বিরুদ্ধে ওসমানীনগর থানায় মামলা আছে। তাদের সেই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কোর্টে চালান দেয়া হবে। সেখানে যোগাযোগ করেন। এ সময় তিনি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলেন, দয়া করে এখান থেকে চলে যান। আপনারা নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত করবেন না। এরমধ্যে একজন জানতে চান, ওসমানীনগর থানার মামলাটা কবে করা। উত্তরে ওসি বলেন, আমি এখন বলতে পারবো না। আমাদের কাছে ফরওয়ার্ডিং করেছে। সেই প্রেক্ষিতেই ধরা হয়েছে। আদালতে গেলে জানতে পারবেন বলেও জানান তিনি। এরপর আরিফ ওসিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমরা সিলেটে আইনের পথে চলছি। আমাদের উত্তেজিত করে কেউ কিছু করতে পারবে না। তুমি যদি মনে করো আমাদের পেটাইবা, পেটাও। পেটাও আমাকে। এ সময় উপস্থিত কর্মী-সমর্থকরাও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তারা স্লোগান দিতে থাকেন। সেখানে হট্টগোল সৃষ্টি হয়। পরে আরিফ তাদেরকে শান্ত করে ফিরিয়ে নিয়ে যান।
আরিফ চলে গেলে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন ডিসি আজবাহার আলী সেখ। তিনি বলেন, আমার জোনে দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা ওসমানীনগর থানার ফৌজদারি মামলার আসামি। ওই থানার রিকুইজেশনের প্রেক্ষিতেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি বলেন, হয়রানিমূলক কোনো কিছু করা হচ্ছে না। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন- তারা কারো কর্মী কি কর্মী নন, সেটা আমাদের কাছে বিবেচ্য নয়। গ্রেপ্তার সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সহকারী রিটার্নি অফিসার ও মিডিয়া মুখপাত্র প্রলয় কুমার সাহা বলেন, পুরাতন নিয়মিত মামলা থাকলে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে। আবার নতুন কোনো ফৌজদারি ঘটনায় মামলা করা যাবে।
এদিকে কয়েকটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যেও উত্তেজনা বিরাজ করছে। এরমধ্যে বৃহস্পতিবার নগরীর ২৬ নং ওয়ার্ডে প্রচারণাকালে কাউন্সিলর প্রার্থী এমএ মান্নানের সমর্থকদের ওপর প্রতিপক্ষ হামলা চালায়। এতে তিনজন আহত হন। তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েকদিন আগে একই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী সেলিম আহমদ রনি মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন অপর প্রার্থী মইন উদ্দিনের। নগরীর ২৩ নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী ফারুক ও মোস্তাক আহমদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে দিপু নামে এক যুবক আহত হন। এছাড়া ৫ নং, ২ নং, ৯ নং, ৬ নং, ১৭ নং ওয়ার্ডে প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকরা মুখোমুখি রয়েছেন।
কামরানের দাবি নাটক: এদিকে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রচারণা শুরুর আগে থেকেই বিএনপির মেয়রপ্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ও তার দলের নেতারা নানা নাটক করছেন অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। তিনি গতকাল সিলেটের সুরমা মার্কেট এলাকায় গণসংযোগকালে সাংবাদিকদের কাছে এ অভিযোগ করেন। বলেন, সিলেট নগরীতে এখন প্রচার-প্রচারণা তুঙ্গে। প্রচারণায় মানুষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নৌকার পক্ষে গণজোয়ার দেখে বিএনপি ও তার প্রার্থী সিলেটে নানা নাটক করছে। আর নাটকের অংশ হিসেবে তিনি একেক সময় একেক দৃশ্যের অভিনয় করছেন। উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনী পরিবেশ চলছে দাবি করে কামরান বলেন, সব প্রার্থীর পোস্টার টানানো আছে। সবাই গভীর রাত পর্যন্ত প্রচারণা চালাচ্ছেন। মাইকিং করছেন। এই সুষ্ঠু পরিবেশকে অশান্ত করার নানা পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।
রাজশাহীতে গ্রেপ্তার আতঙ্কে বিএনপি
আসলাম-উদ-দৌলা, রাজশাহী থেকে জানান, দিন যত ঘনিয়ে আসছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের হাওয়া বদল ঘটছে। বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের পক্ষে নেতাকর্মীরা মাঠে কাজ করতে পারবে কিনা সে শঙ্কাও কাজ করছে। ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতকে নিয়ে নির্বাচনে নামার অভ্যন্তরণীর প্রস্তুতিও চূড়ান্ত ছিল। হঠাৎ বিএনপি-জামায়াতের প্রভাবশালী নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার শুরু করছে পুলিশ। এতে চাপের মুখে পড়েছে বিএনপি। গতকাল বিকেলে রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবরে বিএনপি প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল হোসেন তপু এই অভিযোগ করেন। এর আগে বহরমপুর, ডিঙ্গাডোবা, কড়াইতলা এলাকায় গণসংযোগ চালিয়েছেন ধানের শীষের প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল।
গত তিনদিনে রাজশাহী ৩ আসনের সংসদ আয়েন উদ্দিন, রাজশাহী ৫ আসনের আবদুল ওয়াদুদ দারা ও সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘন করে নৌকা প্রতীকের ভোট প্রার্থনা, দলীয় নেতাকর্মীদের ওয়ারেন্টছাড়া গ্রেপ্তার, ভয়-ভীতি প্রদর্শনসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে প্রতিকার দাবিতে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে এই অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
শুক্রবার রাতে মহানগর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওয়াসকুরুনি ডায়মন্ড, মহানগর যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাইনুল হক হারু, রাজপাড়া ছাত্রদল সম্পাদক হাফিজুল ইসলাম আপেলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর গতকাল দুপুরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মহানগর যুবদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন শিবলী, ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি গোলাম নবী গোলাপ, ২৬নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ইসতিয়াক মাহমুদ বাবুকে। একে নির্বাচনের নামে প্রশাসনের এক ধরনের প্রহসন হিসেবে দেখছে দলটি। তারপরও খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে বিএনপি শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবে বলে জানিয়েছে বিএনপি।
মান-অভিমান চলা জামায়াতের সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নিয়েছিল বিএনপি। চলছিলো বিভিন্ন কাউন্সিলর পদে তাদের প্রার্থীকে ছাড় দেয়ার দরকষাকষি। এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন জামায়াতের মহানগর নায়েবে আমীর অ্যাডভোকেট আবু ইউসুফ মোহাম্মদ সেলিম। গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টা আগে শুক্রবার রাতে মানবজমিনকে এই জামায়াত নেতা বলেন, ‘কেন্দ্রীয়ভাবে ২০ দলীয় জোটের একক প্রার্থী ঠিক করা হয়েছে বুলবুলকে। আমরা তার সমর্থেনই কাজ করছি। তবে পরিবেশগত কারণ, বিশেষ করে থানা কমিটির আমীর ও ওয়ার্ডে নেতা এমনকি কাউন্সিলর প্রার্থীকে গ্রেপ্তার, নেতাকর্মীদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা প্রদান, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাঁধার কারণে জামায়াত মাঠে নামতে পরছে না। আবার না নামলেও মামলা-হয়রানি, জেল-জুলুম থেকে দলীয় নেতাকর্মীরা রেহাই পাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ প্রার্থী লিটনের নামে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ এনে চারজন নারী কর্মীসহ মোট ২৭ জন জামায়াত নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
বিএনপি প্রার্থীর প্রচারণা বহরে জামায়াত না থাকলেও ভেতরে ভেতরে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি আছে এমন ১৩ জন কাউন্সিলর ও দুই সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে দলটি। জামায়াত নীরবে কাজ করছে তাদের ১, ২, ৫, ৬, ১৩, ১৪, ১৭, ১৮, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীকে বিজয়ী করতে। এরই মধ্যে গত ১৭ই জুলাই কোর্ট কলেজ এলাকায় ২ নম্বর ওয়ার্ডে জামায়াতের কাউন্সিলর প্রার্থী মোখলেসুর রহমানের পক্ষে প্রচারণা চালাতে গিয়ে ছাত্রলীগের বাধার মুখে পড়েন জামায়াতের ৪ নারী কর্মী। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের ১ মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেন। ওইদিন নগরীর জাহাজঘাট এলাকায় ২৮ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা জামায়াতের আমীর বেলী বেগমকে নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে সরকারবিরোধী বক্তব্য রাখায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করে।
জামায়াতের শীর্ষ নেতার গ্রেপ্তারের খবরে ঢাকা মহানগর জামায়াতের রুকন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আশরাফুল আলম ইমন তার ফেসবুক স্টাট্যাসে বলেন, ‘মহাশয় গণগ্রেপ্তার করে কি সমর্থন আদায় করা যায়? চাপ ও ভীতি প্রদর্শন করে কি পক্ষে আনা যায়? তার এই মন্তব্যকে অনেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে জামায়াতের গোপন সমঝোতার আলামত হিসেবে দেখছেন।
তবে বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ সালাম বিপ্লব জামায়াত বিএনপি প্রার্থীর সঙ্গে আছে উল্লেখ করে বলেন, ‘এটি উনার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত। জামায়াত জোটগত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০ দলীয় প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের পক্ষে কাজের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আর এর জের ধরেই জামায়াত নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’
দলীয় সূত্র জানায়, রাজশাহীতে বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারসহ ভোটকেন্দ্রে না যেতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। গত শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে গতকাল বিকাল পর্যন্ত বিএননি-জামায়াতের অন্তত ৭ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি বিএনপির। তারা বলছে, সম্প্রতি বিএনপির গণসংযোগে ককটেল হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী মামলায় বিএনপির নেতাকর্মীদেরই গ্রেপ্তার করছে। আবার ধানের শীষের নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুরের ঘটনায় আওয়ামী লীগ বাদী হয়ে মামলা করেছে। সেই মামলায়ও বিএনপির নেতাকর্মীদেরই গ্রেপ্তার করছে। এতে করে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু বলেন, ‘বিএনপির পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে দেখে অন্যায়ভাবে এই ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রশাসন আমাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। কিন্তু ভোটকেন্দ্র কীভাবে পাহারা দিতে হয় তার কৌশল বিএনপির জানা আছে। নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে থাকবে বিএনপি এবং বিজয়ী হবে। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ৬০ হাজার ভোটে সরকার দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করবে উল্লেখ করে বলেন, মিথ্যা প্রচার করে কোনো লাভ নেই। জনগণ আওয়ামী লীগের চরিত্র সম্পর্কে জানেন। সরকারের ঘৃণ্য আচরণে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। এই নির্বাচনে তারই প্রতিফলন ঘটাবে।
লিটনকে বিএনপি কাউন্সিলরের সমর্থন: আসন্ন নির্বাচনে আওযামী লীগ প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে সমর্থন দিয়েছেন বিএনপি নেতা বর্তমান কাউন্সিলর মনির হোসেন। শুক্রবার সন্ধ্যার পর নগরীর ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে তিনি লিটনকে সমর্থন দেন। একই সঙ্গে নৌকার পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য লিটনের কাছ থেকে প্রচারপত্র গ্রহণ করেন।
মনির হোসেন মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী। নিজের পক্ষে প্রচারণার পাশাপাশি নৌকার পক্ষেও প্রচার চালাবেন বলে তিনি ঘোষণা দেন।
মনির হোসেন বলেন, ‘আমি দল করি বিএনপি, কিন্তু রাজশাহীর উন্নয়নের স্বার্থে লিটন ভাইকে ভোট দিবো, আমার পরিবারের সবাইও লিটন ভাইকে ভোট দেবে।’
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে শুক্রবার বিকেলে ১৮ নং ওয়ার্ডে গণসংযোগে যান আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়রপ্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। সন্ধ্যায় তিনি ১৮ নম্বর ওয়ার্ড (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত হয়ে বিএনপিপন্থী এই কাউন্সিলর প্রার্থী নৌকার পক্ষে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন।
বরিশালে আতঙ্কে বিএনপি কর্মীরা
মারুফ কিবরিয়া, বরিশাল থেকে জানান, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণায় শুক্রবার পর্যন্ত বেশ সক্রিয় ছিলেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারের নেতাকর্মীরা। কিন্তু শনিবার সকাল থেকেই অনেকটা ঝিমিয়ে গেছে নগরীতে তাদের পদচারণা। গ্রেপ্তার আতঙ্কে তারা কিছুটা পিছু হটতে শুরু করেছেন। বরিশাল শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে এমন চিত্রই লক্ষ্য করা গেছে। বিএনপির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, মূলত গ্রেপ্তারের ভয়েই মাঠে দেখা মিলছে না কর্মী-সমর্থকদের।
সরজমিন দেখা যায়, শুক্রবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারের পক্ষে দলের সমর্থকরা দফায় দফায় নগরীর বিভিন্ন স্থানে প্রচারণায় অংশ নিলেও গতকাল সকাল থেকে সেটা কমেছে অনেকাংশে। দলীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন না গণসংযোগে। নগরীর ১১নং ওয়ার্ডের কয়েকটি এলাকায় দলের পক্ষ থেকে প্রচারণা চালানো হয়। তবে সেটা এই প্রচারণায় পুলিশি বাধা পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন মহনগর বিএনপির সহকারী সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক তারিন। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমরা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সেক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বাধা দেয়া হচ্ছে। কোথাও গণসংযোগ করতে গেলে সেটা কম সময়ের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের দলীয় লোকজন সদর রোড দিয়ে মিছিল করলে তাদের কিছু বলে না। কিন্তু আমাদের দলীয় নেতাকর্মীরা নামলেই থামিয়ে দেয়। গ্রেপ্তার আতঙ্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দলীয় নেতাকর্মীরা ভয়ভীতি পাচ্ছেন। শুক্রবার আমাদের যুবদলের নেতা কবীরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। কিন্তু আজ (শনিবার) বিশেষ ক্ষমতায় আইনে গ্রেপ্তার করে দেখিয়ে কোর্টে চালান করে দিয়েছে। তার আগে শুক্রবার বরিশাল মহানগর জামায়াতের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন মো. বাবরকে একইভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জহির উদ্দিন মো. বাবুর বিরুদ্ধেও কোনো মামলা ছিল না। তাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ (গতকাল) কোর্টে চালান করে দেয়া হয়েছে।
এদিকে সূত্র বলছে, বিএনপির প্রচারণায় এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও বাধা প্রয়োগ করা শুরু করেছেন। রাস্তায় মিছিল মিটিং নিয়ে নামলেই তাদের অভিমুখে পাল্টা মিছিল নিয়ে বের হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিএনপি নেতা বলেন, আমরা কিছু প্রকাশ্যে বলতে এলেই আমাদের থামিয়ে দেয়া হয়। আমাদের নেতারা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে গেলে বাধা দেয়া দেয়। সরাসরি না পারলে পুলিশ দিয়ে থামানোর চেষ্টা করে। এমনকি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা আসলেও তাদের পাঁচজন একসঙ্গে হাঁটতে পারবেন, বেশি মানুষ জড়ো হওয়া যাবে নাসহ নানা শর্তজুড়ে দেয়া হয়। তিনি আরো বলেন, মূলত শুক্রবার রাতে জামায়াতের নেতা ও বিএনপির যুবদলের নেতাকে গ্রেপ্তারের পর থেকে দলীয় লোকজনের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। ঘর থেকে বের হলেই গ্রেপ্তার হওয়ার শঙ্কা তাদের মধ্যে। তাই এখন নির্বাচনী প্রচারণায় কেউ সেভাবে বের হতে পারছেন না। বিএনপির আরেক কর্মী জানান, নির্বাচনের প্রচারণার শুরুর দিন থেকেই রাতে বাসায় থাকছেন না। বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেয়ে জানতে পারেন তাকে যেকোনো সময় বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। যে কারণে নির্বাচন পর্যন্ত তিনি গা ঢাকা দিয়েই থাকবেন।
গতকাল কাশিপুর বাজারে সকাল ১১টার দিকে প্রচারণায় অংশ নেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানসহ দলের অন্য নেতাকর্মীরা। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে আছে জনগণ। আগামী ৩০শে জুলাই জনগণ বিএনপিকে বিপুল ভোটে জয়ী করে ক্ষমতাসীন সরকারের দুঃশাসন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ জানাবে। আব্দুল্লাহ আল নোমান আরো বলেন, বুলেটের চেয়ে ব্যালট বেশি শক্তিশালী। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জনগণকে পাশে থাকার আহ্বান জানান তিনি।
অন্যদিকে সকাল দুপুরেই ১১নং ওয়ার্ডে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারের পক্ষে প্রচারণা চালান নেতাকর্মীরা। পাশাপাশি চানমারী এলাকায় প্রচারে গিয়েছেন সরোয়ার নিজেই। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে ইভিএম নিয়ে কথা বলেন। এসময় সরোয়ার জানান, ইভিএম নিয়ে তিনি আগেই আপত্তি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে ইভিএম আমি চাই না। নির্বাচন কমিশন জোর করে দিলে তাতে কিছু করার নেই।
বিএনপির পক্ষ থেকে গতকালের এই কয়েকটি প্রচারণা দেখা গেছে। তবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মতো সরব থেকে মাঠে অবস্থান করতে দেখা মেলেনি কোথাও। শুধু তাই নয়, বরিশাল শহরজুড়ে বিএনপি মেয়র প্রার্থীর ব্যানার ফেস্টুন বা পোস্টার ছিল সংখ্যায় খুব নগন্য। নগরীর বেশিরভাগ জায়গাই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পোস্টারে ছেয়ে গেছে।
সূত্র: মানবজমিন