ডক্টর তুহিন মালিক
এক- মিডিয়া পুরোপুরি কন্ট্রোল করেও কোন দিশা খুঁজে পাচ্ছে না সরকার। এরশাদ শাসনামলের দীর্ঘ কয়েক যুগ পর মার্শাল ল স্টাইলে এবার সরকারী ফরমান জারী করা হলো সংবাদ প্রচারের উপর। বাস্তবতা হচ্ছে, মিডিয়া হাউজগুলোর মালিক পক্ষের কেউ সরকারী দলের নেতা। কেউবা আবার সরকারের সহযোগী। সম্পাদক কিংবা বার্তা বিভাগের লোকজনদের কেউ আবার সরকারী চাটুকার। কেউ নির্লজ্জ দলদাস। মিডিয়া হাউজের কেউ আবার দলকানা সাংবাদিক নেতা।সেলফ সেন্সরশীপের খড়গে সত্য প্রকাশের সব দুয়ার যখন বন্ধ। তখনই সোস্যাল মিডিয়া দাঁড়িয়ে গিয়েছে সত্য প্রকাশের একমাত্র অবলম্বন হয়ে।
দুই- এভাবে দেখতে দেখতে গুটিকয়েক সরকারী চাটুকারীতার স্রোতে পুরো সংবাদ মাধ্যমটাই গণমানুষের বিদ্বেষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয়েছে। এতে সংবাদকর্মীরা পড়েছে চরম বিপদে। একদিকে নিজেদের চাকরী বাঁচানো।পত্রিকা টিভি রক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে গণমানুষের চরম হতাশা এবং অশ্রদ্ধার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সম্পাদক, মালিক ও সরকার পক্ষের ত্রিমুখী চাপ। সত্য বললেই সিরিজ মামলা। নয়তো ৫৭ ধারায় কারাবাস। আরেকটু বেশী বাড়লে গুম, খুন বা ভেসে উঠা লাশ।
তিন- অন্যদিকে নগদ অর্থ, মোটর সাইকেল, গাড়ি, ফ্লাট, মিডিয়ার মালিক বা পরিচালক, ব্যাবসার অফার, ব্যাংকের পরিচালক, ইউনিয়ন নেতা, এমপির হাতছানি- কত রকমের মায়াময় প্রলোভনের গড্ডলিকা প্রবাহ! এতে করে ধীরে ধীরে পুরো সংবাদ মাধ্যমের আত্মত্যাগের ঐতিহ্যটাই যেন তাসের ঘরের মত ধ্বসে পড়েছে বিগত কয়েক বছরে।যারাই মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছে, তাদের উপরে নেমে এসেছে নিপীড়নের মুষল বর্ষণ।
চার- অথচ আজ যখন দূর্বার ছাত্র আন্দোলনে পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, ডাক্তার, শিক্ষক, দল, নেতা, সুশীল- কেউই রাস্তায় নামলো না; ক্রান্তিকালে এই ‘হলুদ’ আর ‘দালাল’ সাংবাদিকরাই কিন্তু রাজপথে বুঁকের রক্ত দিলো।
পাঁচ- গতকাল বার্তাসংস্থা এপির এএম আহাদ, জুমা প্রেসের রিমন, প্রথম আলোর আহমেদ দীপ্ত, জনকণ্ঠের জাওয়াদ, বণিক বার্তার পলাশ শিকদার, সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষার্থী, প্রিয় ডটকমের রিপোর্টার প্রদীপ দাস ও হেড অব নিউজ রফিকুল রঞ্জু প্রদীপ এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক রাহাত করিম ও এনামুল হাসানসহ অসংখ্য সংবাদ কর্মীকে প্রকাশ্য রাজপথে ছাত্রলীগ কর্মীরা মাথায় হেলমেট, মুখে কাপড়, হাতে রড, রাম দা ও লাঠি দিয়ে রক্তে রঞ্জিত করে দিল। ৩০ জন সাংবাদিকদের একটি গ্রুপকে ধাওয়া দিয়ে ৭ জন ফটোসাংবাদিকে সাপের মত পেটানো হলো। তাও আবার পুলিশের চোখের সামনে!
ছয়- সবশেষে গতকাল রাতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটো জার্নালিষ্ট ও দৃক গ্যালারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল আলমকে ধানমন্ডির বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে ডিবি পুলিশ। অপহরনের কয়েক ঘন্টা আগে তিনি চলমান ছাত্র বিক্ষোভে সরকারী দমন-পীড়ন নিয়ে আল জাজিরায় একটি সত্যনিষ্ঠ সাক্ষাৎকার দেন।
সাত- ছাত্রলীগের নারকীয় হামলায় রক্তস্নাত ফটোসাংবাদিক এম আহাদ ল্যাবএইড হাসপাতালে। দুই ডজন ছাত্রলীগ কর্মীর পৈচাশিক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত আহমেদ দীপ্ত স্কয়ার হাসপাতালে। যুগান্তরের আরমান ভূঁইয়া, দৈনিক আমার সংবাদের খোকন সিকদার, পরিবর্তন ডটকমের ফররুখ বাবু, মানবজমিনের শাহীন কাওসার, সুদীপ অধিকারী, ডেইলি স্টারের শায়ের রিয়াজ, রাফি হোসেন, সুস্মিতা এস পৃথা, বিডিমর্নিং এর আবু সুফিয়ান জুয়েল, কালেরকণ্ঠের নিশক তারেক আজিজ, টাইমস বিডি জার্নালের অরণ্য জিয়া- এদের সবাইকে একযোগে ছাত্রলীগের নরপশুদের রক্তক্ষয়ী নির্মমতার ভয়াবহ শিকার হতে হয়েছে।
আট- আর দিনশেষে এই ‘হলুদ’ সাংবাদিকরাই নিজেদের রক্ত দিয়েই প্রমান দিলো- তাদের রক্তের রং হলুদ নয়, লাল। জাতির ক্রান্তিকালে গণমাধ্যম জেগে উঠলে, জেগে উঠবে বাংলাদেশ।