মিরাজ খন্দকার
এই বছরের মধ্যে দুটি বড় ছাত্র আন্দোলন হয়েছে। কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন। দুটি আন্দোলনই ছিল জনদাবী। প্রথমটি সার্বজনীন না হলেও নিরাপদ সড়ক চাই এই আন্দোলন সবারই আন্দোলন। এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ছিল সবার। সবাই চেয়েছে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা যাতে ফিরে আসে। দূর্ঘটনার হার যাতে কমে আসে।
দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাস্তায় নেমে এসেছে স্কুলের ছাত্ররা। তাদের আন্দোলন ও দাবিগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষ জোরালো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। আদতে সড়ক, যানবাহন চলাচল ও গণপরিবহনে বহুদিন ধরেই নৈরাজ্য চলছে। আমাদের দেশে সড়ক, যান চলাচল ও যাত্রীর তুলনায় দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর হার বেশি। সাধারণত নগরের অভ্যন্তরে সুশৃঙ্খল ট্রাফিক ব্যবস্থা এবং কিছুটা নানা যানবাহনের ভিড় থাকায় সব গাড়িরই গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।
তাই শহরের ভেতরে দুর্ঘটনার হার হাইওয়ের তুলনায় সাধারণত কম হয়। আর হলেও দুর্ঘটনায় ক্ষতিও কম হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারটা আলাদা। সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬ শতাংশই হয় শহরের ভেতরে, আবার শহরের ভেতরের দুর্ঘটনার মধ্যে ৭৪ শতাংশই ঘটে রাজধানী ঢাকায়। আর এসব দুর্ঘটনায় প্রায়ই প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে, যা স্বাভাবিক নয়। গত এক বছরে ঢাকা মহানগরীতে সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪১৭ জন। এটা অনেক বেশি।
যে শহরে গাড়ি চলে হাঁটার গতিতে, তিন-চার কিলোমিটার পাড়ি দিতে তিন ঘণ্টাও পেরিয়ে যায়, একটি ট্রাফিক সিগন্যালে কখনো আধা ঘণ্টার বেশি অপেক্ষায় থাকতে হয়, যেখানে অহরহ উল্টো দিকে যান চলাচল করে, ফ্লাইওভারের মুখে গণপরিবহনে যাত্রী ওঠানামা করে, ফ্লাইওভারেই পাল্লা দিয়ে ওভারটেক করে, সেখানে দুর্ঘটনা স্বাভাবিক। আর এত নৈরাজ্য সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা, অপারগতা দেখে দেখে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে তাদের দোষ দেওয়া মোটেই সমীচীন নয়।
তাই একটি সড়ক দুর্ঘটনা, দুটি মৃত্যু ও নয়জনের আহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের এই আন্দোলন এমন ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছে। রাজপথে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, শিশু ও জনগণ সেই বার্তাই দিয়েছে। ছাত্ররা পথে নেমে উল্টো যাত্রী থামিয়েছে, সরকারের প্রবীণ মন্ত্রীকে বাধ্য করেছে সঠিক পথে যেতে, বিশৃঙ্খলভাবে চলতে অভ্যস্ত রিকশাকে কাতারবন্দী করে চলতে শিখিয়েছে, আর বিভিন্ন গাড়ির কাগজপত্র চেক করে দেখেছে গণপরিবহনের বড় একটি অংশের ফিটনেস থেকে চালকের লাইসেন্স ঠিক নেই।
সরকার শুরুতে এই আন্দোলনের ব্যাপারে অনেকটা সহনশীল থাকলেও শেষ পর্যন্ত আর সহনশীল থাকে নি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতই পরিণতি হয়েছে এই আন্দোলনটির। ছাত্রদের নয় দফা দাবীর বেশিরভাহ এমনকি মূল দাবীটিই গুরুত্ব পায়নি সরকারের কাছে। অবহেলাজনিত ও বেপরোয়াভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটালে চালকের মৃত্যুদণ্ড দাবী করেছে ছাত্ররা। কিন্তু সরকার অনুমোদন করেছে মাত্র পাঁচ বছর তাও আবার প্রমাণ সাপেক্ষে। মৃত্যু নিয়ে হাসি তামাশা করা নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানও পদত্যাগ করেনি।
মুলত সরকার এখন আর জনগণের সরকার নয়। সরকারের দরকার পড়ে না জনগণের ভোটের। সরকার টিকে আছে পেশিশক্তির উপরে। গদি ধরে রাখতে সরকারের দরকার সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনী আর পুলিশ। তাই পুলিশসহ সরকারি কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা দিনকে দিন বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আর সন্ত্রাসীদের লালন করা হচ্ছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নামে।
সরকারকে যে কোন বেকায়দা অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে জীবনবাজি রেখে প্রস্তুত থাকে ছাত্র ও শ্রমিকেরা। এবারও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। গদি টিকিয়ে রাখতে সরকার তাই কিছু সংখ্যাক ছাত্রকে সুবিধা দিতে ব্যবস্থা করেছে কোটার। আর অসাধু শ্রমিকদের অবৈধ সুবিধা দিতে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনকে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সরকারের প্রয়োজন নেই মানুষের নিরাপত্তার। সরকারের দরকার নেই নিরাপদ সড়কের। সরকারের শুধু চাই ক্ষমতা। গদি টেকাতেই এদেশে স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব ছাত্রদের শত্রু বানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক