মুসাফির রাফি
জামায়াতের বিরুদ্ধে একজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান একটি প্রস্তাব এনেছেন মর্মে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল এবং এর সমর্থক মিডিয়া কয়েকদিন খুব লম্ফঝম্প করলেও তারা সুকৌশলে যে বিষয়টা এড়িয়ে গেছে তা খুবই ভয়াবহ। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে একটা দল সমস্যায় পড়বে দেশ নয়। কিন্তু অতি সম্প্রতি মার্কিন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে সর্বসম্মতভাবে একটি প্রস্তাব পাশ করেছে যেখানে বাংলাদেশের উপর অবরোধ আরোপেরও হুমকি দেয়া হয়েছে। এতে কোন দল নয়, গোটা দেশ সংকটে পড়ে যাবে। অথচ এই প্রস্তাবনা নিয়ে তেমন কোন কথা বা আলোচনা কোথাও শুনলাম না।
বলা হয়েছে যদি বাংলাদেশে যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন না হয়, এবং তাদের অনুমোদিত প্রস্তাবের দাবীগুলোকে বিবেচনায় না নেয়া হয় তাহলে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার উপর যেভাবে মার্কিন কংগ্রেস ও সিনেট অবরোধ আরোপ করেছে, একই ধরনের অবরোধ বাংলাদেশের উপরও আরোপিত হবে।
প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির উইলিয়াম আর কিয়েটিং। এইচআর ১১৬৯ শীর্ষক এই প্রস্তাবনাটি গত ১২ ডিসেম্বর সর্বসম্মতভাবে হাউজে পাশও হয়ে গেছে। এই প্রস্তাবনায় বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে পুনর্ব্যক্ত করা হয়। প্রস্তাবনায় বলা হয়:
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করেছে এবং দেশটিতে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও নানা মতের ও বিশ্বাসের লোকজন বসবাস করে। বাংলাদেশ পৃথিবীর ৮ম জনবহুল দেশ এবং দেশটিতে কমপক্ষে ষোল কোটি মানুষ বসবাস করছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্নতা, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস এবং ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তথাপি বাংলাদেশের গণতন্ত্র অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। এখনো দেশটিতে রাজনৈতিক সহিংসতা, পরিবেশ দূষণ, জংগীবাদ, প্রায় ১০ লাখের উপর রোহিঙ্গা শরনার্থী এবং বাক স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সংকটসহ নানা ধরনের সমস্যা বিরাজ করছে।
যে কোন দেশেই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলো সেই দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মুল ভিত্তি। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন তখনই হয় যখন সকল ভোটারের জন্য পর্যাপ্ত স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু যেভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর হামলা হচ্ছে তা দেশটির জনগণের দীর্ঘদিনের ত্যাগ ও তিতিক্ষাকে ম্লান করে দিচ্ছে। মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি দেশটির দায়বদ্ধতাও এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
এর আগে অবাধ নির্বাচনের সুযোগ না থাকায় দেশটির প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনকে বয়কট করেছিল। দেশটিতে আবার আগামী ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এখানে মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর স্থিতিশীলতা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থও জড়িত রয়েছে।
যেহেতু দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সরকারের সাথে মিলে দেশটির মানবাধিকার সুরক্ষা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র সংহতকরনে কাজ করে যাচ্ছে, তাই সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ক্রমবর্ধমান হামলা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বৃদ্ধি এবং অস্থিতিশীল পরিবেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। এই প্রেক্ষাপটে, মার্কিন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ নিম্নোক্ত অবস্থান ঘোষণা করছে:
১.মার্কিন সরকার বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়।
২.বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানানো হচ্ছে যাতে তারা বাক স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে এবং নির্বাচন কমিশনের সুপারিশের আলোকে সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বিধান করে।
৩.রাজনৈতিক দল ও বিচার বিভাগের প্রতি আহবান জানানো হচ্ছে যাতে তারা সবাই ভোটারের ইচ্ছার প্রতি সম্মান রাখেন এবং এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরী করেন যাতে সকল বাংলাদেশী নির্বাচনে স্বাধীনভাবে ভোট প্রদান করতে পারে আর নির্বাচনটি যেন নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহনমুলক হয়। এবং
৪.অসহায় রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয় দেয়া এবং মানবিক সংকটের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ায় বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানানো হচ্ছে।
উল্লেখ্য এই মাসের শুরুতেই নির্বাচন কমিশন নানা অজুহাতে বিএনপি চেয়ারপার্সন, কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী জোটের ১৫০ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করে। যে সমস্ত মানদন্ডে বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে, সেই সব শর্ত একইভাবে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ক্ষেত্রে কমিশন প্রয়োগ করেনি বলেও অভিযোগ রয়েছে। এর পাশাপাশি বিরোধী প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারনায় সরকারী দলের ক্যাডার ও পুলিশেরা বাঁধার সৃষ্টি করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এই প্রস্তাবনা না মানলে কি হতে পারে?
মার্কিন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের প্রস্তাবনা আমেরিকার জনগণের মতের বহি:প্রকাশ। মার্কিন প্রশাসনও এই প্রস্তাবনার আলোকে উদ্যেগ নিতে দায়বদ্ধ। যেহেতু ইতোপূর্বে বাংলাদেশের সরকার মার্কিন হাউজের বেশ কিছু প্রস্তাবনাকে অগ্রাহ্য করেছে, সেই প্রেক্ষিতে আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই- যদি এই প্রস্তাবটাও তারা অগ্রাহ্য করে তাহলে তাদের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবরোধ আরোপ করতেও দ্বিধাবোধ করবেনা। এখানে উল্লেখ্য যে, এর আগে ইরান বা উত্তর কোরিয়ার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে অবরোধ দিয়েছিল, তার আগেও মার্কিন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে এভাবেই প্রস্তাবনা পাশ করা হয়েছিল।
ভারতের ভুমিকা কেমন হওয়া উচিত:
ভারত বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ বলেই সবাই জানে। মার্কিন কংগ্রেসেও ভারতের লবি কার্যকর। কিন্তু তারা এই প্রস্তাব পাশের সময় নিরব ছিলেন বা সমর্থন করেছিলেন বলেই মার্কিন এই প্রস্তাবটি হাউজে সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়।
ভারত অবশ্য এখনো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নিরবতা পালন করছে। এর কারন সম্ভবত এটাই যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেও দেশে বেশ চাপের মুখে রয়েছেন। সাম্প্রতিক রাজ্যসভার নির্বাচনগুলোতে তার ভরাডুবি হয়েছে এবং অনেকেই মনে করছেন ২০১৯ সাথে অনুষ্ঠিতব্য পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে বিজেপি ও তার দল পরাজয় বরন করতে যাচ্ছে।
২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে ভারত আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিল। এই সরকার ক্ষমতায় বসে ভারতকে তার প্রতিদান হিসেবে অনেকগুলো সুবিধাও দিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতি হলো ’আমেরিকা ফার্স্ট। তাই আমেরিকা এখন তার বিদেশ নীতি নির্ধারন করার ক্ষেত্রে ভারত বা তৃতীয় কোন দেশের পরামর্শ আর শুনবেনা। বরং বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারত বেশী মাথা গলালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেটা ভালভাবে নাও নিতে পারেন।
সূত্র: মার্কিন কংগ্রেস