আগের রাতে কোনো কারসাজি হতে পারে, এমন আশঙ্কা ছিল শামসুন নাহার হল ছাত্রী সংসদ নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীদের। এ কারণে ভোটের আগের রাতেই তাঁরা পাহারা বসান ভোটকেন্দ্রসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে। এই পাহারা ছিল ভোট গণনা ও ফল ঘোষণা পর্যন্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র এই হল সংসদে পুরো স্বতন্ত্র প্যানেল জিতেছে। এই হলে স্বতন্ত্র প্যানেলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগের প্যানেল। এর বাইরে বামপন্থী একটি প্যানেল থেকে কেবল দুটি পদে প্রার্থী দেওয়া হয়েছিল।
স্বতন্ত্র প্যানেল শামসুন নাহার হল সংসদের ১৩টি পদের মধ্যে ৯ টিতে প্রার্থী দেয়, সব প্রার্থীই জিতেছেন। এর মধ্যে সহসভাপতি (ভিপি) পদে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী শেখ তাসনীম আফরোজ (ইমি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নির্বাচিত ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী আফসানা ছপা নির্বাচিত হন।
ডাকসু নির্বাচনে বিভিন্ন হলে ভোট নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। যে কয়টি হলের ভোট গ্রহণ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, তার মধ্যে শামসুন নাহার অন্যতম।
এ জন্য আগাম সতর্ক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীরা। এই হলের নির্বাচিত ভিপি শেখ তাসনীম আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগের দিন রাত জেগে আমরা ভোটকেন্দ্র পাহারা দিয়েছি। দিনের বেলায়ও আমরা ভোটকেন্দ্রের আশপাশে থেকেছি। সমর্থকদের সজাগ থাকতে বলেছি, যাতে কোনো অনিয়ম না হতে পারে। যখন ভোট গণনা হয়, তা আমাদের সামনে গণনা করা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি যে সবকিছু যেন আমাদের চোখের সামনেই হয়।’
শেখ তাসনীম গত বছর কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ও সোচ্চার ছিলেন। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পক্ষেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার ছিলেন। সে সময় গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তাঁকে পুলিশ আটক করে সাড়ে তিন ঘণ্টা পর ছাড়ে। তাসনীম বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংগঠন ‘স্লোগান ৭১ ’–এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
তাসনীম বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল তাঁদের প্যানেলের প্রতি। সবাই একটা পরিবর্তন চেয়েছিলেন।
একই কথা বলেন নবনির্বাচিত জিএস আফসানা ছপাও। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে হলে নানা অনিয়মের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ত্যক্ত-বিরক্ত ছিলেন। অন্যদের মতো তাঁরাও এসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, তাই সবার মনের কথাটা তুলে ধরতে পেরেছেন।
আফসানাও মনে করেন, তাঁদের সতর্কতার কারণে এই হলের ভোট নিয়ে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে থেকেই আমাদের আশঙ্কা ছিল যে আগের রাতে কিছু হতে পারে। তখন চিন্তা করেছি যে সারা রাত কেন্দ্র পাহারা দেব। টিভি রুমে ভোটকেন্দ্র ছিল। তার আশপাশে আমরা পাহারা দিয়েছি। ভোট গ্রহণ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মেয়েরা পাহারায় ছিল।’ তিনি জানান, বেলা তিনটায় ভোট গণনা শুরু থেকে রাত সাড়ে আটটায় ফল ঘোষণার সময় পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাঁরা সেখানে বসে ছিলেন। ভোট গণনা শেষে প্রাধ্যক্ষ ব্যালটগুলো নিয়ে বের হতে চাইলে তাঁরা আটকে দেন এবং তাঁদের সামনে ফল ঘোষণা করতে বাধ্য করেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই সমর্থনটার জন্যই তাঁরা জিততে পেরেছেন।
মেয়েদের অন্যান্য হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেকে জিতেছেন, তবে শামসুন নাহারের মতো পুরো প্যানেল নয়। ভোটের দিন অনিয়মের প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও মেয়েরা এগিয়ে ছিল। এ প্রসঙ্গে শেখ তাসনীম বলেন, মেয়েদের হল থেকে প্রতিবাদ আগেও হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়েও মেয়েরা প্রতিবাদমুখর ছিলেন। এ ছাড়া মেয়েদের হল সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন সহজে নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে না, যা ছেলেদের হলে সম্ভব হয়।
সবাই মিলে কিছু চাইলে সেটা সম্ভব বলে মনে করেন শামসুন নাহার হলের নবনির্বাচিত ভিপি ও জিএস। তাঁরা বলেন, ভয় পেলে চলবে না। সাধারণ শিক্ষার্থীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে অনেক কিছু করা যায়, তার প্রমাণ গত বছরের এপ্রিলের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে দেখে এসেছেন তাঁরা।
ডাকসুতে পুনর্নির্বাচনের দাবি উঠেছে। এ ব্যাপারে শেখ তাসনীম বলেন, যদি আবার নির্বাচনের দাবি ওঠে, তাহলে সবগুলো পদেই পুনর্নির্বাচন হওয়া উচিত। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সসহ সবকিছু সবার চোখের সামনে করতে বাধ্য করতে হবে।
শামসুন নাহার হল সংসদের নবনির্বাচিত এই প্যানেল সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে চায়। আবাসন সংকট নিরসনসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাওয়া নিয়ে প্রশাসনের কাছে যাওয়াটাই তাঁদের লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন।
স্বতন্ত্র প্যানেলের নির্বাচিত অন্যরা হলেন সহসাধারণ সম্পাদক ফাতিমা আক্তার, সাংস্কৃতিক সম্পাদক সামিয়াজ জাহান, সাহিত্য সম্পাদক তাহসীন, অভ্যন্তরীণ ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক খাদিজা বেগম, বহিরঙ্গন ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মাহমুদা আক্তার, সমাজসেবা সম্পাদক শিরিন আক্তার ও সদস্য তামান্না তাসনীম।
সূত্র: প্রথম আলো