অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত টানা ১০ বছর ধরে দেশ শাসন করতেছে আওয়ামী লীগ। দেশ শাসনে আওয়ামী লীগের সফলতা-ব্যর্থতা এখন দেশবাসীর সামনে পরিষ্কার। শেখ হাসিনার দাবি হলো-বাংলাদেশ এখন সব দিক দিয়ে বিশ্বের কাছে রোল মডেল। দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে তার সরকার অত্যাধুনিক করে গড়ে তুলেছে। সীমান্ত নিরাপত্তায় বিজিবিকে শক্তিশালী করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার সরকার মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষা দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক শক্তিশালী।
আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবীরা টকশোতে গিয়ে প্রতিদিন গলাবাজি করে বেড়াচ্ছে যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন পরাশক্তিতে পরিণত হয়ে গেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সঙ্গে নাকি এখন কারো নেতৃত্বের তুলনা হয় না। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মাথাকে এমনভাবে উঁচু করে দাড় করিয়েছে যে, ব্রিটেনের আইফেল টাওয়ারও ছুঁতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই বলে?
বিএনপি-জামায়াতের বিগত শাসনামল ও আওয়ামী লীগের বর্তমান শাসনামলে মধ্যে তুলনা করলে ফলাফলটা এমন আসে যে, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা হলো এমন একজন মেদভুড়ি ওয়ালা লোকের মতো যার মেরুদ-ের হাড়গুলো ক্ষয় হয়ে গেছে। লোকটা দেখতে বেশ মোটা সোটা মনে হলেও আসলে তার ভেতরের অবস্থা খুবই খারাপ। যেকোনো সময় সে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। শেখ হাসিনাও বিগত ১০ উন্নয়নের বেলুনগুলো শুধু ফুলিয়েই যাচ্ছেন, ভেতর অবস্থা আসলে খুবই খারাপ। একটি রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী, নিরাপত্তাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে যে নৈতিক শক্তি থাকে বর্তমানে বাংলাদেশের সেই নৈতিক শক্তি নেই। রাষ্ট্রের যে মেরুদ- থাকে সেই মেরুদ-ের হাড়গুলো ক্ষয় হয়ে গেছে। মেরুদ-ের হাড়গুলো ক্ষয় হয়ে বাংলাদেশ এখন এমনই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, পুচকা মিয়ানমার বাংলাদেশের নাগরিকদেরকে অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে গেলেও সরকার উচ্চস্বরে কোনো শব্দ করতে পারে না।
সরকারের ১০ বছরের শাসনামল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মেরুদণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ ৩টি হাড় ক্ষয় হয়ে গেছে।
জাতির মধ্যে বিভেদ-অনৈক্য সৃষ্টি
যেসব রাষ্ট্র বিশ্বে উন্নত ও সব দিক থেকে শক্তিশালী হিসেবে পরিচিত তাদের দেশের নাগরিকদের মধ্যে রয়েছে ঐকমত্য। রাজনৈতিক মত পার্থক্য থাকলেও দেশের স্বার্থে ক্ষমতাসীনরা বিরোধীদেরকে প্রাধান্য দেয়। দেশের স্বার্থে সবাই এককাতারে। কিন্তু, বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র একেবারেই ভিন্ন। সোজা কথায় বলা যায়-অনৈক্য আর বিভেদে জর্জড়িত দেশের নাম হচ্ছে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশের মানুষকে বিভক্ত করে ফেলেছে। শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতাদের ভাষায়-যারা আওয়ামী লীগ করে না তারা সবাই স্বাধীনতা বিরোধী। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের ধোয়া তুলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশে এখন গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় বিদেশি কোনো শক্তি যদি বাংলাদেশের দিকে রক্তচক্ষু উচু করে তাকায় তাহলে মোকাবেলা করার জন্য সরকার জনগণকে পাশে পাবে না। কারণ, সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতনে জনগণ এখন দিশেহারা অবস্থায় আছে। মোট কথা-বহিঃশক্তির মোকাবেলায় একটি দেশের নাগরিকদের মধ্যে যে ঐক্য থাকা দরকার বাংলাদেশে বর্তমানে সেটা নেই। এই সুযোগটাও বিদেশি শক্তি গ্রহণ করে।
দলীয় অনুগত সামরিক ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনী
একটি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে তারা হলেন সামরিক ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। বলায় তারাই আসলে রাষ্ট্রের প্রধান শক্তি। যুদ্ধটা মূলত তারাই করে। আর জনগণ পেছন থেকে তাদেরকে সমর্থন দিয়ে উৎসাহীত করে। প্রেরণা যোগায়। কিন্তু, বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। দেশের সামরিক, সীমান্ত রক্ষী, র্যাব ও পুলিশকে সরকার একেবারে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করেছে। যারা রাষ্ট্রের নাগরিকদের জান-মালের নিরাপত্তার চেয়ে একটি স্বৈরাচারী সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ব্যস্ত। গত ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনেও সারাবিশ্ব এটা প্রত্যক্ষ করেছে।
দেখা গেছে, নিরাপত্তা বাহিনীগুলো সরকারের দলীয় বাহিনীতে পরিণত হওয়ার কারণেই সীমান্তে প্রতিদিন বাংলাদেশি নাগরিকদেরকে বিএসএফ পাখির মতো গুলি করে হত্যা করলেও বাংলাদেশ কোনো শক্ত প্রতিবাদ করতে পারছে না। ছোট রাষ্ট্র মিয়ানমারের সৈন্যরা যুদ্ধ বিমান নিয়ে সীমান্তে ঢুকে গেলেও বাংলাদেশ কোনো জবাব দিতে পারছে না।
অথচ, একটু অতীতের দিকে তাকালেই ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনী বাংলাদেশের বীর জোয়ানদের কাছে পরাজয় বরণ করেছে। এমনকি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর ভারতীয় বাহিনীকে পরাজিত করেও বাংলাদেশের বীর জোয়ানরা সিলেটের পাদুয়া ও রৌমারিতে ভূখণ্ড রক্ষা করেছে।
১৯৯১ ও ২০০০ সালে মিয়ানমারের সাথে সীমান্তে বিডিয়ারদের সংঘর্ষে মিয়ানমার বাহিনী পরাজিত হয়েছে। ২০০০ সালে তো মিয়ানমারের ৬ শতাধিক সৈন্য নিহত হয়েছিল।
এরপর ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর পাদুয়া ক্যাম্পটি ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। দীর্ঘদিন যাবত তারা বাংলাদেশের পাদুয়া গ্রামটি দখল করে রাখছিল। ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাদুয়া গ্রামটি ছেড়ে দেয়ার জন্য বিএসএফকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা কোন সাড়া দেয়নি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বিডিয়ার জোয়ানরা ২০০১ সালের ১৫ এপ্রিল রাতে পাদুয়া গ্রাম পুনরুদ্ধার করে এবং সেখানে ৩টি ক্যাম্প স্থাপন করে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে। ভারতীয় বাহিনী সেদিন একটি টু-শব্দ করার সাহস পায়নি। ভারতীয় বাহিনী পাদুয়ার প্রতিশোধ নিতে ঘটনার তিনদিন পর ১৮ এপ্রিল বেআইনিভাবে বড়াইবাড়ী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভূখন্ডে প্রবেশ করে বড়াইগ্রামে নগ্ন হামলা চালিয়েছিল। তাদের এই হামলার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিল বিডিয়ার জোয়ান আর বীর জনতা। দেশের স্বাধীনতা ও ভূখ- অক্ষুন্ন রাখতে সেদিন আমাদের ৩ জন বিডিয়ার জোয়ান শাহাদাত বরণ করলেও ভারতীয় বাহিনীর দাম্ভিকতা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিল। বিএসএফের ১৬ জন সদস্য নিহত হয়েছিল। সেদিন ভারতীয় বিএসএফ আমাদের বিডিয়ারদের কাছে শুধু পরাজয়ই বরণ করেনি, নিহত বিএসএফ সদস্যদের লাশ ফেলে রেখে তারা পালিয়ে গিয়েছিল।
সেদিনের ঘটনায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রীতিমত হতচকিত হয়ে যায়। প্রথমে ভারত সরকার বিষয়টি হজম করার চেষ্টা করলেও প্রচার মাধ্যম ও বিরোধীদলের চাপে পড়ে এ নিয়ে পরে সোচ্চার হয়। ঘটনাটি ভারত ও তার বিশাল সামরিক বাহিনীর ইজ্জতের উপর একটা বড় ধরনের আঘাত ছিল।
কিন্তু সেই বাংলাদেশ আজ এতই দুর্বল যে, ভারত এবং মিয়ানমার যা খুশী তাই করছে। বাংলাদেশ এখন তাদের কাছে গরিবের বউয়ের মতো। এর মূল কারণ হচ্ছে, সশস্ত্র বাহিনী ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে সরকার দলীয় বাহিনীতে পরিণত করেছে। এদের মধ্যে যারা দেশপ্রেমিক আছেন তাদেরও চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। কারণ, তারা এখন সরকারের রোষানলের শিকার। বর্তমানে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি জনগণের কোনো আস্থা বিশ্বাস নেই। জনগণ তাদেরকে এখন আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মী হিসেবেই মনে করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিপর্যয়
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের এখন চরম বিপর্যয় ঘটেছে। এমনকি যে দেশের জন্য শেখ হাসিনা সব কিছু করছেন সেই ভারতের সঙ্গেও এখন বাংলাদেশের সম্পর্ক ভাল নেই। এগুলোর বাস্তব প্রমাণ হলো রোহিঙ্গা সংকট। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের লোকজন মায়া কান্না করলেও বাস্তবে এনিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে কোনো দেশ নেই। আজ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর কোনো র্ষ্ট্রাই চাপ সৃষ্টি করেনি। যার কারণে, মিয়ানমার এখন বাংলাদেশের ভুখন্ড সেন্টমার্টিনকে বারবার নিজেদের ভুখন্ড হিসেবে মানচিত্রে দেখানোর সাহস পাচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠানোর পর মিয়ানমার বাহিনী একাধিকবার সীমান্তে যুদ্ধবিমান নিয়ে ঢুকে গেছে। সাগরেও তারা বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করে জেলেদেরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এমন সাহস তারা কোথায় পাচ্ছে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমার আসলে সংঘাত চাচ্ছে। আর পর্দার আড়াল থেকে কয়েকটি দেশ মিয়ানমারকে উস্কে দিচ্ছে। ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল সবাই মিয়ানমারের পক্ষে কাজ করছে। মিয়ানমার যদি বাংলাদেশের ওপর হামলাও করে তাহলে কোনো রাষ্ট্র কেই পাশে পাবে না বাংলাদেশ। হয়তো রোহিঙ্গাদের মতোই তারা সহানুভূতি প্রকাশ করবে এবং মিয়ানমানরকে নরম সুরে বলবে সংযত আচরণ করার জন্য। এমন কি মিয়ানমার বাংলাদেশ যুদ্ধ হলে দেখা যাবে, চীন-ভারতের দেয়া অস্ত্রই ব্যবহার করবে মিয়ানমার। মোট কথা-বিশ্বের কোনো পরাশক্তি যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পাশে এসে দাড়াবে না।