অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সরকার স্বীকার না করলেও সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারি আকার ধারণ করেছে। এডিস মশার কামড়ে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। আর ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত প্রায় শতাধিক মানুষ মারা গেছে। যদিও সরকার এ মৃত্যুর সংখ্যা স্বীকার করছে না। এই এডিস মশা নিয়ে যখন সারাদেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে তখনও জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ও ছলচাতুরি করে যাচ্ছে সরকার। নকল ওষুধ দিয়ে এতদিন এডিস মশা মারার অভিনয়ও করেছে সরকার।
এদিকে, সর্বোচ্চ আদালত ভাল ওষুধ আনার নির্দেশ দেয়ার পরও এনিয়ে সরকার দুই নাম্বারী করে যাচ্ছে। আদালত ও জনগণের সমালোচনার মুখে বিদেশ থেকে ওষুদের নমুনা আনলেও সেটা দিয়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী মশা মরছে না।
শুক্রবার মশা নিধনে নতুন ওষুধের মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা চালিয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি)। নগর ভবনের মূল ফটকের সামনে তিনটি খাঁচার প্রতিটিতে ৫০টি করে মশা রেখে পরীক্ষা চালানো হয়। আধা ঘণ্টার পরীক্ষা শেষে খাঁচাগুলোয় যথাক্রমে ২২, ২৬ ও ১৮ শতাংশ মশা মারা গেছে। ‘বায়ার করপোরেশন’ কোম্পানির এই মশার ওষুধের ৩০ মিনিট পরীক্ষা শেষে সর্বোচ্চ ২৬ শতাংশ মশা মারা গেছে।
কিন্তু ভারতের কলকাতা থেকে আসা গবেষক দলের সদস্য শুভ দে সাংবাদিকদের বলেন, বায়ার করপোরেশনের ওষুধ মশকনিধনে কার্যকর। ভারতীয় এই গবেষকের দাবি নিয়ে নগরভবনের কর্মকর্তাদের মধ্যেই সন্দেহ সংশয় দেখা দিয়েছে। কয়েকজন বলেছেন, বায়ার করপোরেশনের ওষুধ কার্যকর হবে বলে মনে হচ্ছে না। ভারতীয় এই গবেষক দলের নিশ্চয় ওই কোম্পানির সঙ্গে কোনো লিংক আছে। যার কারণে তারা কোম্পানির পক্ষে সাফাই গাইছে।
অপরদিকে, আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো এডিস মশা মারতে সরকার এখন এমন ওষুধের কথা চিন্তা করছে যা মানুষ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি সরূপ।
জানা গেছে, সরকার বিদেশ থেকে যে চারটি ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেগুলোর দুটি জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ না হওয়ায় ‘প্রত্যাহার’ করে নিয়েছে থাইল্যান্ড সরকার। আর একটি ওষুধ পরিবেশসম্মত না হওয়ায় এক যুগ আগে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রেজিস্ট্রেশন বাতিল করেছে। এছাড়া একটি ওষুধ নিয়ে বিতর্কের কথা জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদরা।
জানা গেছে, ডেঙ্গু নিয়ে চলমান সংকট নিরসনের জন্য গত ২৮ জুলাই বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের যৌথ উদ্যোগে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কীটনাশক বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, সভায় বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী ৪-৫টি ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কোন কোন ওষুধ কেনা হবে সেটা চূড়ান্ত হয়নি। তবে বৈঠকে সিদ্ধান্ত না হলেও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কিছু ব্যক্তি নির্দেশে দুই সিটি কর্তৃপক্ষ চারটি ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। যার মধ্যে দুইটি ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় থাইল্যান্ড সরকার এগুলো প্রত্যাহার করে। আর বিপিএল লিমিটেড কোম্পানির ‘ম্যালাথিউন ৫৭% ইসি’ কীটনাশকটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বাতিল হওয়া কীটনাশকের তালিকায় রয়েছে। পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলায় ২০০৭ সালের দিকে এর রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে সংস্থাটি। এর সিরিয়াল নং এপি-৬৮। এর আগে ২০০৩ সালের দিকে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন মশা নিধনে এই ওষুধটি ব্যবহার করতো। বর্তমানে বাতিল হওয়া এই ওষুধটিও কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাকি ওষুধগুলোর রেজিস্ট্রেশন নেই।
এ বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, প্রিমিফোস-মিথাইল ৫০% ইসি নিয়ে একটু কথাবার্তা রয়েছে। তারা কি এটাও তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছে? আর ‘ম্যালাথিউন ৫৭% ই সি’ যদি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর নিষিদ্ধ করে থাকে তাহলে সেদিন যে মিটিং হয়েছিল সেখানে তাদের পরিচালকসহ সবাই উপস্থিত ছিলেন। তারা কেন বিষয়টি অবহিত করলেন না? যদি নিষিদ্ধ করা হয়, কী কারণে করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা দিলেন না? তাদের তো মিটিংয়ে ডাকা হয়েছে, তারা সরকারকে গাইড করবে। সেখানে গিয়ে কেন মুখ বন্ধ করে ছিলেন?’
তিনি বলেন, ‘আমিও ওই কমিটির সদস্য। সেই মিটিংয়ে তো নির্দিষ্ট কোনও ওষুধের নাম উল্লেখ করা হয়নি। সেখানে ৪ থেকে ৫টি ওষুধ রেজিস্ট্রেশনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে যাতে একটিতে সমস্যা হলে অন্যটি ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সিটি করপোরেশন এই তালিকা কোথায় পেলো?’
আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরিচালক (বালাইনাশক প্রশাসন ও মান নিয়ন্ত্রণ) কৃষিবিদ এজেডএম ছাব্বির ইবনে জাহান বলেন, ‘এই সিদ্ধান্তটি সরকারের হাই পজিশন থেকে হয়েছে। তাই কোনও মন্তব্য করতে পারবো না।’
এই কর্মকর্তার বক্তব্য থেকেও বুঝা যায় যে, মিটিংয়ের সিদ্ধান্তের আলোকে কিংবা কীটত¦ত্ত্ববিদদের মতামতের আলোকে ওষুধ কেনা হচ্ছে না। সরকারের উচ্চপর্যায়ের কিছু লোক তাদের পছন্দের কোম্পানির কাছ থেকে মূলত ওষুধ কেনার চেষ্টা করছে। এখানে জনস্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থই বেশি দেখছে তারা।