অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সড়ক পথে যাতায়াতের চেয়ে রেলপথকে নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করেন যাত্রীরা। পরিসংখ্যানও সে কথাই বলছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে যেসব ট্রেন যাতায়াত করে সেগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ গতি ৫০ থেকে ৫৫ কিলোমিটার। কিন্তু তারপরেও বিভিন্ন জায়গায় প্রায়শই ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়, যদিও তাতে প্রাণহানি কমই হয়।
গেল বছরে দুইটি ভয়াবহ ট্রেন দূর্ঘটনা ঘটেছে। যাতে মৃত্যুর সংখ্যা ২০ হলেও হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশী। এসব ঘটনার পর থেকে রেল লাইনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে জনমনে।
সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া দুইটি ট্রেনের সংঘর্ষে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছে। এতে আহত হয়েছে আরও অর্ধশতাধিক যাত্রী। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন কতৃপক্ষ।
মঙ্গলবার ভোররাত সোয়া তিনটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মন্দবাগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা এবং সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেসের মধ্যে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
রেলওয়ে পুলিশের আখাউড়া থানার ওসি শ্যামল কান্তি দাস জানিয়েছেন, তূর্ণা নিশীথার ধাক্কায় উদয়ন এক্সপ্রেসের মাঝের দুইটি বগি দুমড়ে মুচড়ে যায়। এসব বগির নীচে কেউ আটকে পড়ে আছে কিনা তার অনুসন্ধান চলছে।
বগির নীচে কেউ আটকে পড়ে আছে কিনা, তার অনুসন্ধান করছে উদ্ধারকর্মীরা সংকেত বিভ্রাটে এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে তিনি ধারণা করছেন।
তূর্ণা নিশীথার একজন যাত্রী ইজতিহাদ মাশরুর ঘটনাস্থল থেকে বলছেন, উদয়ন এক্সপ্রেসের মাঝ বরাবর দুইটি বগি দুমড়ে মুচড়ে পড়ে।
দুর্ঘটনাটি ঘটার সময় ট্রেন দুইটি চলন্ত অবস্থায় ছিল। এই ঘটনার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেট-চট্টগ্রামের মধ্যে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগেও মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের কয়েকটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে তিন নারীসহ অন্তত চারজন নিহত হয়। এ ঘটনায় আহত হয় শতাধিক মানুষ।
বাংলাদেশে রেলপথের রয়েছে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার এবং নিয়মিত কর্মচারীর সংখ্যা ২৫ হাজারের মতো।
রেলের কোচ ক্রয় এবং রেলপথ সম্প্রসারণের জন্য নানা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে গত ১০ বছরে। কিন্তু দূর্ঘটনা যেন বেড়েই চলেছে। তাবে কেন এত বেশী দূর্ঘটনা?
পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, নতুন প্রকল্পের প্রতি মনোযোগী হলেও পুরনোগুলো রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি কমই নজর দেয়া হচ্ছে।
অধ্যাপক আলমের বর্ণনায়, ” আমরা বানাই, ভুলে যাই, আবার বানাই। মাঝখানে যে এটাকে রক্ষণাবেক্ষণ করে টেকসই এবং নিরাপদ রাখবো সেই কালচারটা (সংস্কৃতি) কখনোই আমাদের গড়ে উঠেনি।”
তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় স্থানীয় মানুষজন রেলপথের নানা ত্রুটির বিষয়গুলো তুলে ধরে। ফলে অনেক সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
রেল লাইন এমন একটি বিষয় যেটিকে সবসময় পর্যেবক্ষণের মধ্যে রাখতে হয়।
যদিও এসবের কোনটা মানতে নারাজ রেল মন্ত্রণালয়। তারা বলছেন, এগুলো নিছকই একটি দুর্ঘটনা। এর মাধ্যমে যাত্রীদের মনে কোন আশংকা তৈরির সুযোগ নেই বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। তারা দাবি করছেন, রেল লাইন নিরাপদ রাখার জন্য তাদের তরফ থেকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়।
“ব্রিটিশ আমলের রেলে ব্যবস্থা খুবই নিখুঁত। নির্দিষ্ট ম্যানুয়াল ফলো করে এর ব্যবস্থাপনা করা হয়। তবে আমাদের লোকবলের কমতি আছে সেটা সত্য। তার মধ্য থেকে আমরা রেলের লাইন মেনটেইনেন্স আমরা নিয়মিত করে যাচ্ছি,” বলছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব।
হঠাৎ করেই বার বার রেল লাইনে দূর্ঘটনা হচ্ছে সেটি খতিয়ে দেখার দরকার। রেল লাইনে ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে নাকি এর অন্যকোন কারণ রয়েছে সেটি তদন্ত করতে হবে বলে জানান সচিব।
এদিকে এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঐ ট্রেন দুর্ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদান করার আহবান জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমীর জনাব মকবুল আহমাদ।
এক বিবৃতিতে বলেন, “ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার কসবা উপজেলায় গত ১১ নভেম্বর দিবাগত রাত ৩টায় দু’টি ট্রেনের সংঘর্ষের ফলে বহুসংখ্যক যাত্রী মর্মান্তিকভাবে নিহত এবং শতাধিক যাত্রী আহত হওয়ার ঘটনায় আমি গভীর শোক ও উদ্বেগ প্রকাশ করছি।
তিনি বলেন, আমি আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঐ ট্রেন দুর্ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদান করবেন এবং এ ধরনের দুর্ঘটনা আর যাতে না ঘটতে পারে সে ব্যাপারে উপযুক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
ট্রেন দুর্ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবার-পরিজন ও আহতদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের যথাযথভাবে চিকিৎসা সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে নিহতদের পরিবার-পরিজন এবং আহতদের পাশে দাঁড়াবার জন্য আমি স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও কর্মীগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
ট্রেন দুর্ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন আমি তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং তাদের শোক সন্তপ্ত পরিবার-পরিজন ও আহতদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।”
এছাড়া এই ঘটনায় নিহতদের পরিবার-পরিজনদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. মোবারক হোসাইন ও সেক্রেটারি জেনারেল সিরাজুল ইসলাম।
তারা বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলস্টেশনে তুর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া অর্ধশতাধিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ দুর্ঘটনায় আরও হতাহতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় আমরা গভীর শোকাহত এবং গোটা জাতি আজ শোকাহত। আমরা আহতদের সুচিকিৎসা প্রদানসহ এ ধরণের সড়ক-দূর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও নিহতদের পরিবার-পরিজনদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। একই সাথে সর্বস্তরের জনগণকে যার যার সাধ্যমত দূর্ঘটনাকবলিতদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করছি। আশা করি রেল কর্তৃপক্ষ এ ধরণের দূর্ঘটনা রোধে আরো সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
রেল দূর্ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন আমরা তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং তাদের শোক সন্তপ্ত পরিবার পরিজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান তারা।