অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নারকীয় হামলা করে বিদেশিসহ ২২ জনকে হত্যার ঘটনায় ৮ জঙ্গির মধ্যে ৭ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আদালত। একজনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। বর্বরোচিত এ হামলা মামলার রায়ে দেশি-বিদেশি সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবে, খুনীদের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের চেয়ে আদালতের ভেতর তাদের মাথায় থাকা আইএসের লোগো সম্বলিত কালো টুপি এখন নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বুধবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সাত জন আসামীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়ার পর দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের একজন রাকিবুল হাসান রিগ্যানকে দেখা যায় মাথায় একটি কালো টুপি। কালো ওই টুপিটির উপর ছিল অবিকল আইএস-এর কালো পতাকাটির উপর সাদা রঙে আঁকা প্রতীকটি।
দেখাগেছে, রিগ্যান রায় ঘোষণার পরই আদালত কক্ষেই কোন এক ফাঁকে মাথায় টুপিটি পরে ফেলেন। তারপর তাকে পাঁচ তলা থেকে নিচতলায় প্রিজন ভ্যানে এনে ওঠানো পর্যন্ত তিনি মাথায় পরে ছিলেন ওই টুপিটি।
এ সময় ওই এলাকায় ছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শত শত সদস্য। রিগ্যানকেও ধরে ছিল পুলিশের কয়েকজন। কিন্তু কেউই রিগ্যানকে এই টুপিটি পরতে বাধা দেয়নি বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন। এমনকি টুপিটি খুলে নেয়ার চেষ্টা করতেও দেখা যায়নি কাউকে।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী রিগ্যান যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলেন, তখন তাকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, ‘আমি আইএস-এর লোক’। আদালত কক্ষ থেকে প্রিজন ভ্যানে এনে তোলা পর্যন্ত আধা ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আইএস-এর এই প্রতীক প্রদর্শন করেন রিগ্যান।
এসময় আদালতে উপস্থিত সাংবাদিকেরা বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আব্দুল্লাহ আবু’র নজরে আনেন। তখন তিনি পরামর্শ দেন, রিগ্যান কীভাবে এই টুপিটি পেল সেই প্রশ্ন সে যাদের হেফাজতে আছে তাদেরকে করতে।
এটি বাংলাদেশের একটি হাই সিকিউরিটি প্রিজন বলে পরিচিত। গুরুত্বপূর্ণ আসামীদেরকে সাধারণত এই কারাগারে রাখা হয়। কারাগারের বাইরের যেকোনো সামগ্রী প্রবেশে সেখানে কড়াকড়ি থাকে। সেক্ষেত্রে এরকম একটি স্পর্শকাতর প্রতীক সম্বলিত টুপি কীভাবে রিগ্যানের কাছে পৌঁছালো, তা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে এমন একটি দিনে রিগ্যান এই প্রতীকটি প্রদর্শন করলো যেদিন হোলি আর্টিজান হামলা মামলার রায় প্রধান উপলক্ষে নিরাপত্তা কড়াকড়ি জোরদার করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে আইএস সহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক আছে প্রথম থেকেই। র্যাব-পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত জঙ্গি আস্তানার সন্ধান ও পরবর্তীতে কথিত জঙ্গি আখ্যা দিয়ে গুলি করে হত্যার পর লাশ বের করার ঘটনাগুলোকে মানুষ আর বিশ্বাস করে না। সবগুলোকেই র্যাব-পুলিশের সাজানো নাটক বলে মনে করে সাধারণ মানুষ।
তবে, গুলশানের ঘটনা নিয়ে কারো মনে কোনো প্রকার সন্দেহ নেই। সেদিন শুধু বিদেশি নাগরিক নয়, দুইজন পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত হয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে সরকার জঙ্গি বিরোধী ব্যাপক অভিযান চালায়। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে জঙ্গি আখ্যা দিয়ে শতাধিক মানুষ গুলি করে হত্যা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। নিহতের অনেকের পরিবার থেকেই অভিযোগ করা হয়েছে যে, ৬ মাস কিংবা ১ বছর আগে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এসব ঘটনার পর সরকার ও র্যাব-পুলিশের পক্ষ থেকে বার বার দাবি করা হচ্ছে যে বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই।তাদের কোনো কার্যক্রম কিংবা কোনো সদস্য দেশে নেই। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে-সর্বোচ্চ নিরাপত্তার পরও আদালতের এজলাসে জঙ্গিদের হাতে আইএসের টুপি যায় কিভাবে? তাহলে কি প্রশাসন আই এস নিয়ন্ত্রণ করে?
ঢাকার জেল সুপার মাহবুব ইসলাম বলেছেন, ‘জঙ্গিদের যখন জেল থেকে বের করা হয়, তখন তাদের কাছে আইএসের কোনো ধরনের টুপি ছিল না। একজন বের হয়েছে গোল সাদা টুপি পরিহিত অবস্থায়। বাকি সাতজনের কাছে কোনো অবস্থাতেই টুপি ছিল না। দায়িত্বরত অফিসাররা তাদেরকে পূর্ণ তল্লাশি সম্পন্ন করে প্রিজনভ্যানে তুলেছেন। আমাদের কাছে সিসিটিভির ফুটেজ এবং ভিডিও ফুটেজ আছেও বলে দাবি করেন।
অপরদিকে, ঢাকার অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার ও আদালতের পুলিশের প্রধান (ডিসি) জাফর হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘জেল থেকে বের হওয়ার সময় যদি তাদের কাছে কোনো ধরনের টুপি না থাকে, তাহলে তারা আইএসের টুপি পেল কীভাবে?
সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হলো-আদালতে উপস্থিত আইনজীবী-সাংবাদিকসহ শত শত মানুষ এবং ভিডিও ফুটেজে দেশবাসী জঙ্গিদের মাথায় আইএসের টুপি দেখলেও বাংলাদেশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান, অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম দেখেন নি। আসামির মাথায় আইএসের টুপির সাদৃশ্যের বিষয়ে তিনি বলেছেন, জানা মতে, আইএসের কোনো টুপি নেই। আইএসের সৃষ্টি থেকে এ যাবৎ পর্যন্ত কোনো টুপি তারা তৈরি করেনি।
আদালতের ভেতর জঙ্গিদের মাথায় আইএসের টুপি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। টেলিভিশন টকশোতেও এনেিয় চুলছেড়া বিশ্লেষণ করছেন রাজনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে জঙ্গিদের হাতে আইএসের টুপি দেয়া সম্ভব না। পুলিশের মাধ্যমেই এটা করা হয়েছে। হতে পারে, দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে থাকার কারণে পুলিশের কেউ কেউ তাদের আদর্শ ধারণ করতেও পারে।
অনেকে বলছেন, সরকারের প্রশাসনেই এখন আইএস আছে। পুলিশের সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই জঙ্গিদের হাতে আইএসের টুপি যেতে পারে না। এমনকি ডিবি মনিরুলও একাজে জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন তারা। এছাড়া অনেকেই আবার ক্ষমতাসীনদের কৌশলও হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন।
এদিকে আইএসের টুপিটা আসলে বাংলাদেশের মাথায়ই পরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ডক্টর তুহিন মালিক।
তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, কয়েক দিন আগে থেকেই পুরো আদালত এলাকায় নিশ্ছিদ্র নিয়ন্ত্রণসহ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে আসছিল সরকারি বাহিনীগুলো। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা জানিয়েছিলেন র্যাবের মহাপরিচালক। আগামী কয়েক দিন র্যাব সতর্ক অবস্থায় থাকবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। অথচ এতো তর্জন-গর্জনের মাঝে দেশবাসীর সাথে গোটা বিশ্ব আজ দেখলো, বাংলাদেশের আদালত চত্বরে জঙ্গিদের মাথায় আইএসের টুপি!
তিনি প্রশ্ন তুলে তুলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে সরকারী হেফাজতে আটক থাকা রাষ্ট্রের অতি সংবেদনশীল ও আন্তরাষ্ট্রীয় জঙ্গি কর্মকান্ডে জড়িত এই হাই প্রোফাইলের আসামীদের মাথায় আইএসের লোগো খচিত এই টুপি তাহলে কে পরিয়ে দিলো? এই জঙ্গিরা কাশিমপুরের হাই সিকিউরিটি কারাগারে বন্দি থাকা স্বত্বেও এই টুপি তাদেরকে কে দিলো? এতো এতো নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও কঠোর পাহারার মধ্যে আদালত চত্বরে এই টুপি তাদেরকে কে দিলো? হাতকড়া পরা কিংবা দুই হাত ক্রাচে ভড় দেয়া এইসব মারাত্মক জঙ্গির মাথায় এই টুপি কে পরিয়ে দিলো?
এটা তারাই পরিয়েছে, যারা জানে আজকে আদালতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও হাই কমিশনের লোকজন উপস্থিত আছেন। হামলায় নিহত বিদেশি নাগরিকদের স্বজনরা উপস্থিত আছেন। দেশ বিদেশের সাংবাদিক, ক্যামেরা, মিডিয়া উপস্থিত আছে। তারা জানে, আজকের রায়টা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হবে। তাই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মাথায় আইএস জঙ্গিদের টুপির প্রদর্শনীটাই তাদের আসল চাওয়া ছিল।
টুপির বিষয়ে তদন্ত করতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের মাথায় আজ যে জঙ্গিবাদের টুপি পরিয়ে দেয়া হলো, সেই রাষ্ট্রীয় কলঙ্ক কি এইসব তদন্ত কমিটির রিপোর্টে মোচন করা আদৌ সম্ভব হবে বলে প্রশ্ন রাখেন এই আইনজ্ঞ।
আসলে, বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসাবে উপস্থাপন করতে পারলে যারা সবচাইতে বেশি বেনিফিশিয়ারি। যারা এদেশকে জঙ্গি মুক্ত করার নামে আগ্রাসন চালাতে উদগ্রীব। তাদের নির্দেশনা ছাড়া রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চোখের সামনে এতবড় একটা ঘটনা এই মুহুর্তের বাংলাদেশে অন্যকারো পক্ষে কোনভাবেই ঘটানো সম্ভব না।
আশ্চর্য, কেউ নাকি কিছুই জানে না! পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেমন পুশইনের খবর জানেন না! আর সরকারও জঙ্গিদের মাথার টুপির খবর জানে না! কারণ তারা দেখাতে চাচ্ছে, এদেশ থেকে জঙ্গি এখনো শেষ হয়ে যায় নাই। আর জঙ্গি দমনে যেকোনো পন্থায় হোক না কেন তাদের ক্ষমতায় থাকাটা কতটা জরুরী।
পুনশ্চঃ- ২০১৭ সালের ১ মে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়ায়’ একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। খবরে বলা হয়, “ভারতের প্রবীণ কংগ্রেস নেতা এবং মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিং স্বীকার করেছেন, এই অঞ্চলে আইএসের নামে ওয়েবসাইট চালায় ভারতের তেলেঙ্গানার পুলিশ।”