অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সম্প্রতি বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত কৃষি পণ্যের নাম হচ্ছে পেঁয়াজ। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করার একদিন পরই বাংলাদেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। ৩০-৪০ টাকা কেজি দরে কেনা পেঁয়াজ কিনতে হয় ২৫০-৩০০ টাকা কেজিতে। নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সকলের জীবনই পেঁয়াজের ঝাঁজে হয়েছে নাজেহাল। পেঁয়াজের দাম রেকর্ড ছোঁয়ার পরে এ নিয়ে সারাদেশের মানুষের মধ্যে যেমন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় তেমনি তার প্রভাব পড়ে সামাজিক মাধ্যমেও। সেখানে অনেকেই এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি রসিকতাও করতে দেখা গেছে।
এখন প্রশ্ন হলো বাজারে কি শুধুই পেঁয়াজের মূল্য বেশি? নাকি পেঁয়াজের উর্দ্ধমূল্য আলোচনায় রেখে অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অসহনীয় মূল্যকে কৌশলে আড়ালে রেখে দেয়া হচ্ছে? দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় মূল্য জনগণ কিভাবে গ্রহণ করছে? নাকি এরই মধ্যে নাভিশ্বাস উঠেছে জনগণের?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে অনুসন্ধান চালায় অ্যানালাইসিস বিডি। বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) রাজধানীর ধানমন্ডি, হাতিরপুল, যাত্রাবাড়ী, মালিবাগ রেলগেট বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে শীতকালীন সবজির পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও দাম কমছে না। বরং নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে চলেছেন অসাধু বিক্রেতারা। একই অবস্থা শাক ও ডিমের বাজারে।
এসব বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি পটল বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, ঝিঙা ৬০ থেকে ৮০ টাকা, করলা ও উস্তি ৫০ থেকে ৭০ টাকা, কাকরোল ৫০ থেকে ৬০ টাকা, বেগুন ৫০ থেকে ৮০ টাকা, ঢেঁড়স ৪০ থেকে ৫০ টাকা, হাইব্রিড শসা ৪০ টাকা, দেশি শসা ৪৫ থেকে ৬০ টাকা, কচুর ছড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা, কচুর লতা ৪০ থেকে ৭০ টাকা, পেঁপে ৩০ থেকে ৪০ টাকা, টমেটো ১০০ থেকে ১২০ টাকা, গাজর ৭০ থেকে ১০০ টাকায়। এছাড়া আকারভেদে প্রতি পিস বাঁধা কপি ৩০ থেকে ৪০ টাকা, ফুল কপি ৩০ থেকে ৫০ টাকা, লাউ ৪০ থেকে ৬০ টাকা, সিম ৮০ থেকে ১০০ টাকা, জালি কুমড়া ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এছাড়া কাঁচা মরিচ প্রতিকেজি ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে ডিম ও সব ধরনের শাক। প্রতি আটি লাল শাক ১২ থেকে ১৫ টাকা, মুলা শাক ১৫ থেকে ২০ টাকা, পালং শাক ২৫ থেকে ৩০ টাকা, কুমড়া শাক ৩০ থেকে ৪০ টাকা, লাউ শাক ৩০ থেকে ৫০ টাকা এবং পুঁই শাক ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এছাড়া পাইকারি বাজারে ৫০ কেজি ওজনের পাইজার ১৬শ টাকা, বেতি ১ হাজার ৭৫০ টাকা, সিদ্ধ জিরাশাইল ২৩শ টাকা, দেশি কাটারী ২ হাজার ৪৫০ টাকা, নুরজাহান ১ হাজার ৫৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ২৫ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা মিনিকেট আতপ ৯২০ টাকা, নাজিরশাইল ১ হাজার ২৫০ টাকা, নতুন চাল ১ হাজার ২০ টাকা, কাটারি সিদ্ধ ১ হাজার ৩শ টাকা, নতুন কাটারী ১ হাজার ২০ টাকা, নুরজাহান সিদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫৫০ টাকায়। ট্রাক সংকট, পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি ও বিরূপ আবহাওয়ার অজুহাতে পাইকারি বাজারে সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবাসায়ীরা।
খুচরা বাজারে চিনিগুড়া চাল প্রতিকেজি ৯৫-১শ টাকা, গোবিন্দভোগ ৮০ টাকা, দেশি নাজিরশাইল ৬০ টাকা, ইন্ডিয়ান নাজিরশাইল ৬৫ টাকা, পাইজার ৪৫ টাকা, জিরাশাইল ৪৮ টাকা, নুরজাহান সিদ্ধ ৩৭ টাকা, বালাম সিদ্ধ ২৫ টাকা, ১ নম্বর কাটারি ৬৫ টাকা, দেশি মিনিকেট ৩৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। পেঁয়াজের দামকে আলোচনায় রেখে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উর্দ্ধমূল্যের বিষয়টি চাপা দিতে চায় বলে মনে করছেন তারা। তারা বলছেন, সরকার পেঁয়াজকে পুঁজি করে অর্থনৈতিক মন্দা ধামাচাপা দিতে চাচ্ছেন। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে তারা বিভিন্ন সময় ইস্যু তৈরী করে জনগণকে দিকভ্রান্ত করতে চাচ্ছে।
বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশী বিনিয়োগ না পেয়ে সরকার দেশের অসাধু ব্যবসায়ীদের উপর নির্ভর করতে শুরু করেছে। অতিমাত্রায় মুনাফলোভী ব্যবসায়ীরা একদিকে জনগণের পকেট কেটে অন্যদিকে নিজেদের আখের গোছানোর পাশাপাশি সরকারের পকেট ভারী করার দায়িত্ব নিয়েছে। এতে সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলাকায় রিক্সা চালিয়ে রোজগার করেন বৃদ্ধ জমির উদ্দিন। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, বয়সের ভারে তিনি খুব বেশি পরিশ্রম করতে পারেন না। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে তিনি যা উপার্জন করেন তা দিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব। তিন সন্তানের জনক জমির উদ্দিনের বড় ছেলে স্থানীয় একটি মটর গ্যারেজে সামান্য মজুরীতে কাজ করেন। অন্যান্য সন্তানেরা এখনও উপার্জনক্ষম নয়। নিজের ও বড় পুত্রের উপার্জন মিলিয়ে বস্তিতে বাসা ভাড়া দিয়ে থাকা খাওয়ার খরচ বহন করা দিন দিন অসম্ভব হয়ে উঠেছে। পিতা-পুত্র দুইজন উপার্জন করেও প্রতিমাসেই কমবেশি ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।
কাঁচা বাজারে বাজার করতে আসা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন এমন কয়েকজনের সাথে কথা হয় আমাদের প্রতিবেদকের। এসময় প্রত্যেকেই চরম হতাশা ও সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আবুল হাসান নামে এক ক্রেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি একজন এনজিও কর্মী। ২০ হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরি করলেও মাস শেষে তার ব্যয় গিয়ে ঠেকছে ৩০ হাজারে। অর্থাৎ প্রতি মাসে তিনি গড়ে অন্তত ১০ হাজার টাকা ঋণে জড়িয়ে পড়ছেন। এ অবস্থা এখন সর্বত্র। একদিকে বাড়ছে বাজারের অস্থিরতা, অন্যদিকে বাড়ছে বাড়ি ভাড়া। সবমিলিয়ে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকিতে পড়ছে দেশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাধারণ জনগণের জীবন ধারণের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে শুধুমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে দেশ এগুতে পারবে না। এতে বরং দারিদ্রের হার বাড়বে। দুর্ভিক্ষের দিকে লাগামহীন গতিতে ছুটতে থাকবে অর্থনীতি।
সূত্র বলছে, সরকার লাগামহীন দুর্নীতি আড়াল করতে ও জনগণের টাকা হাতিয়ে নিতে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের কৌশল ব্যবহার করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশাল বাজেটের অর্ধেক টাকাই সরকারের লোকজন কথিত উন্নয়নের নামে ভুয়া প্রকল্প খুলে লুটে নিচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণ করতেই সরকার বাজার নিয়ন্ত্রনে কোন প্রকার আগ্রহই দেখাচ্ছে না। গত কয়েক মাসে শুধুমাত্র পেঁয়াজ থেকে সরকার কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে বলে সূত্রটি দাবি করেছে।
কনসাস কনজুমার্স সোসাইটি (সিসিএস) এর জরিপ মতে, গত অক্টোবর মাসে পেঁয়াজের বাজার থেকে এক হাজার ৪৬৪ কোটি ৯৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। তখন পেঁয়াজের দাম ছিল ১২০ টাকা কেজি। স্বাভাবিক দামের চেয়ে প্রতি কেজি ৭০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়। প্রতিদিন গড়ে ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।