অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
দেশে বিভিন্ন সময় নির্বাচনে প্রতিদ্বদন্দ্বী প্রার্থীদেরকে অপহরণের খবর আসে। মাঝে মধ্যে প্রার্থীর এজেন্ট বা স্বজনদেরকেও অপহরণ করা হয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরানোর জন্য। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল-রাজনীতির এই নোংরামিটা এখন জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকদের মধ্যেও চলে আসছে। সাংবাদিক কমিউনিটির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে সাইজ করতে এক প্রার্থীর সন্তানকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছে।
গত ৩০ নভেম্বর মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়েছে সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচন। এই নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন দৈনিক খোলাকাগজের সিনিয়র রিপোর্টার তোফাজ্জল হোসেন।
নির্বাচনের আগের দিন ২৯ নভেম্বর (সোমবার) সকালে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে আহসান হাবিব নাহিদকে বাসার সামনের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায় কিছু অজ্ঞাত ব্যক্তি। পরিবারের সদস্যরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে নাহিদকে না পেয়েমোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেন। পরের দিন মঙ্গলবার নির্বাচনের দিন বিকালে র্যাব সদস্য পরিচয়ে একজন ফোন করে জানায়-তার ছেলে মাদারীপুর জেলে আছে।
জানা গেছে, ২০২০ সালে মাদারীপুর রাজৈর থানার মামলা নং-১৭, তাং-১৫/০৬/২০২০ ইং তারিখের মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে সাংবাদিক তোফাজ্জলের ছেলে ঢাকার বাসার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়। জানা গেছে, তোফাজ্জলের বাড়ি গাইবান্ধা জেলায়। তার ছেলে কখনো মাদারীপুরে যায়নি। তাহলে মাদারীপুরে করা ২০২০ সালের মামলায় তাকে তুলে নিয়ে যাবে কেন?
বিষয়টি এখন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ সব সাংবাদিক সংগঠনগুলোর আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসছে। নির্বাচনের আগের দিন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থীর ছেলেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় পুরো সাংবাদিক কমিউনিটি বিস্মিত হয়ে গেছেন। বিশেষ করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নেতৃবৃন্দসহ সব সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির একাধিক সিনিয়র সদস্যরা নিখোঁজের পেছনে বিএনপিপন্থী সাংবাদিক নেতা ইলিয়াস খান ও শওকত মাহমুদকে দুষছেন। তারা বলছেন-তোফাজ্জলকে হারানোর জন্য এবার গভীর চক্রান্ত করেছিল বিএনপিপন্থী সাংবাদিক নেতা ইলিয়াস খান ও শওকত মাহমুদ। তারা তোফাজ্জলকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। তোফাজ্জলের ছেলের ঘটনায় তারাই জড়িত।
তারা জানান, তোফাজ্জল হোসেন একজন ক্লিন ইমেজের মানুষ। এর আগেও তিনি কার্যকরি কমিটির সদস্য ও যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ বছর তিনি ডিআরইউ’র নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই ইলিয়াস খান ও শওকত মাহমুদ তার পেছনে লাগে। বিএনপির কোনো প্রার্থী না থাকায় তোফাজ্জলই এবার নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। পরে তোফাজ্জলকে হারানোর জন্য নয়াদিগন্ত পত্রিকার রিপোর্টার মইন উদ্দিন খানতে মোটা অংকের টাকা দিয়ে তারা তোফাজ্জল হোসেনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাড় করান।
ডিআরইউর একাধিক সদস্য জানান, ইলিয়াস খান ও শওকত মাহমুদ ভোটারদেরকে তোফাজ্জকে জামায়াতের সাথে জাড়িয়ে মিথ্যাচার করে তাকে ভোট না দেয়ার জন্যও বলেছেন। শুধু তাই নয় ডিআরইউ থেকে তাকে নিশ্চিহ্ন করতে বিভিন্ন অপকৌশলও করে আসছে।
অনেক সাংবাদিক আবার বলছেন, তোফাজ্জলের ছেলেকে অপহরণ, গ্রেফতার, জেলের সাথে নিসন্দেহে ইলিয়াস খান ও শওকত মাহমুদ জড়িত। এটা তাদের পরিকল্পনাতেই হয়েছে। তোফাজ্জলকে মেন্টাল টর্চার করতেই তারা নির্বাচনের আগের দিন এটা করেছিল।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সাংবাদিকরা এঘটনার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছেন। সাংবাদিকরা এটাকে নোংরামি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। প্রকাশ্যে কেউ কিছু না বললেও আকার ইঙ্গিতে তারা ইলিয়াস খান এবং শওকত মাহমুদকেই ইঙ্গিত করছেন।
মামলা মাদারীপুরে, ঢাকায় সাংবাদিকপুত্র গ্রেপ্তারে প্রশ্ন
দেড় বছর আগে মাদারীপুরে সন্ত্রাস দমন আইনে এক মামলায় ঢাকা থেকে এক জনকে গ্রেপ্তার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সেই তরুণের বাবা একজন গণমাধ্যমকর্মী। তার অভিযোগ, ছেলেকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি শুরুতে তাকে জানানো হয়নি। এজন্য নিখোঁজ ভেবে তিনি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।
যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই আহসান হাবিব নাহিদ কখনও মাদারীপুরে যাননি বলে দাবি করছে পরিবার। সেখানে ২০২০ সালের ১৪ জুন যে মামলা হয়েছিল, তাতেও তার নাম ছিল না। সেই মামলায় অজ্ঞাত আসামি হিসেবে কয়েকজনের কথা উল্লেখ ছিল, সেই আসামিদের একজন হিসেবেই গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এই নাহিদকে।
নাহিদের বাবা তোফাজ্জল হোসেন কাজ করেন দৈনিক খোলা কাগজে। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন। তবে জিততে পারেননি।
তোফাজ্জল জানান, ভোটের আগের দিন ২৯ নভেম্বর সকালে আদাবরের বাসার সামনে থেকে তার ছেলে নাহিদ নিখোঁজ হন। সে দিনই মোহাম্মদপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তারা। পরদিন দুপুরে তার স্ত্রীর ফোনে র্যাব সদস্য পরিচয়ে একজন ফোন করে জানান, নাহিদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি এখন মাদারীপুর কারাগারে।
মামলা সত্য নয় এগুলো সাজানো গল্প: সাংবাদিক তোফাজ্জেলল
২০২০ সালের ১৪ জুন জেএমবির দাওয়াতি শাখার সক্রিয় সদস্য হিসেবে মাদারীপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় খোকন মিয়া নামে একজনকে। সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯, (সংশোধিত/২০১৩) ধারায় খোকন মিয়াসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১০/১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করে র্যাব।
সেই অজ্ঞাতপরিচয় আসামি হিসেবে নাহিদ ও আবু সাঈদকে ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর আদাবর সম্পা মার্কেট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মাদারীপুরের রাজৈর থানায় করা কথিত মামলার এজাহারে মিথ্যাচার করে লেখা আছে, খোকন মিয়া নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জেএমবির সংগঠক ও দাওয়াতি শাখার সক্রিয় সদস্য। তিনি অন্য সদস্যদের নিয়ে ঢাকা, মাদারীপুর, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় দাওয়াতি কার্যক্রম চালান।
গত ২৯ নভেম্বর গ্রেপ্তারের সময় নাহিদের কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন ও দুটি সিম কার্ড এবং সাঈদের কাছ থেকে একটা মোবাইল ফোন ও একটি সিম কার্ড জব্দ করে র্যাব।
আদালতে নাহিদের সম্পর্কে র্যাবের দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, আহসান হাবিব নাহিদকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, মুসলিম ভাই নামে একজন প্রথমে তাকে আহলে হাদিসে আসার দাওয়াত দেন এবং তখন থেকে নাহিদ আল আমিন মসজিদে যাতায়াত শুরু করেন।
নাহিদ ‘আল্লাহর জন্য ভালবাসা’ ও ‘দ্বীনি আলোচনা’ নামে দুটি গ্রুপ খোলেন বলেও উল্লেখ করেছে র্যাব।
তবে ছেলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মানছেন না তোফাজ্জল হোসেন। তিনি বলেন, ‘এগুলো সাজানো গল্প। অনার্স শেষ করে ১৫ দিন আগে ঢাকায় একটি বেসরকারি আইটি ফার্মে চাকরিতে প্রবেশ করেছে আমার ছেলে। ২৯ তারিখ সকালে অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয় সে। তখন আমার ছেলেকে র্যাব নিয়ে গেছে।
‘আমার ছেলে ছোট থেকে মোহাম্মদপুর এলাকায় বড় হয়েছে। কোনো দিন মাদারীপুর এলাকায় যায়নি। এমনকি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সম্পৃক্ত নয়।’
বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ ও ইউডিজেএফবির আলটিমেটাম
দৈনিক খোলা কাগজের বিশেষ প্রতিবেদক ও নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম, বাংলাদেশের (ইউডিজেএফবি) সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে আহসান হাবিব নাহিদকে অজ্ঞাত মামলায় গ্রেফতারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউডিজেএফবিসহ বিভিন্ন সংগঠন।।
সাংবাদিক নেতারা বলেন, ২০২০ সালের ১৫ জুন মাদারীপুরে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় নাহিদকে গ্রেফতার দেখানো রহস্যজনক। কেননা তার বাবা সাংবাদিক মো. তোফাজ্জল হোসেন ইউডিজেএফবিকে জানিয়েছেন, পেশাগত কারণে তাকে এবং তার পরিবারকে হেনস্তা করতে ছেলেকে গ্রেফতার করানো হয়েছে। মামলাটি মাদারীপুরের, যেখানে তার ছেলে কখনো যাননি। তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজি (বিইউবিটি) থেকে সদ্য স্নাতক শেষ করেছেন এবং তাদের গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধায়।
গত ২৯ নভেম্বর ঢাকার আদাবরের বাসার সামনে থেকে তিনি নিখোঁজ হন। ওইদিন আহসান হাবিব নাহিদের পরিবার মোহাম্মদপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর ৩০ নভেম্বর তার পরিবার জানতে পারে র্যাব-৮ তাকে গ্রেফতার করে মাদারীপুর কারাগারে পাঠিয়েছে।
এ ঘটনায় ইউডিজেএফবি সুষ্ঠু তদন্ত এবং আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার মুক্তির দাবি জানায়। অন্যথায় সাংবাদিক সমাজকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইউডিজেএফবির নেতারা।
Discussion about this post