বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে টানা আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন দলীয় সমর্থকরা। নগর ভবনে তাদের তালা লাগিয়ে অবরোধের কারণে দক্ষিণ সিটি কার্যালয়ে কার্যত অচলাবস্থা বিরাজ করছে। এ দাবি মানা না হলে বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা।
একই সাথে ইশরাকের মেয়র হওয়া না হওয়া বিএনপি এবং অন্তবর্তীকালীন সরকারের মধ্যে একটি ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেন শপথ নিতে পারবেন কী-না সরকারের পক্ষ থেকে সেটিও স্পষ্ট করা হয়নি। এদিকে ক্ষুব্ধ ইশরাক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘আমার বাসস্থানে এসে শপথ পড়ানোর প্রস্তাব দিলেও লাভ নাই।’ একইসাথে অন্তবর্তীকালীন সরকার থেকে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের পদত্যাগ ও আদালতের রায়ের আইনানুগ বাস্তবায়ন দাবি করেছেন তিনি।
প্রশ্ন হচ্ছে আদালতের রায়ের পরেও ইশরাককে মেয়র পদে শপথ পড়াতে বাধা কোথায়? কিংবা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সাথে ইশরাকের দ্বন্দ্বের জায়াগাটা কোথায়?
আদালতের রায়
২০২০ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফজলে নূর তাপস চার লাখ ২৪ হাজার ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তার বিপরীতে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন পেয়েছিলেন দুই লাখ ৩৬ হাজার ভোট। ওই নির্বাচনে অনিয়ম কারচুপির অভিযোগও ছিল বিস্তর।
ভোটের এক মাসের মাথায় ওই বছরের ৩রা মার্চ নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল চেয়ে মামলা করেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গত ১৯শে অগাস্ট ঢাকার দুই সিটিসহ সারা দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সে হিসেবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদ বর্তমানে শূন্য রয়েছে। যে পদে দায়িত্ব পালন করছেন একজন প্রশাসককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২৭ মার্চ ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে রায় দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল। আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গত ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
পরদিন ২৮শে এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মামুনুর রশিদের পাঠানো একটি লিগ্যাল নোটিশে আলোচিত রায় ও শপথ অনুষ্ঠান নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়। নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশের পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইশরাকের শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ নিয়ে রিট করা হয় হাইকোর্টে। কমিশনের দেওয়া গেজেট স্থগিত চেয়ে রিটের ওপর মঙ্গলবার শুনানিও অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে বুধবার আদালত আদেশ দেয়ার কথা রয়েছে।
আইনী জটিলতা
২০২০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফল বাতিল চেয়ে ৩ মার্চ মামলা করেন ইশরাক। ইশরাকের মামলার প্লেইন্ট (প্রাথমিক আবেদন) অনুযায়ী, তিনি অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের আবেদন করেছিলেন। আবেদনে নিজেকে মেয়র ঘোষণা বা অন্য কোন প্রতিকার প্রার্থনা করেননি তিনি।
নির্বাচন সংক্রান্ত যেকোন আপীল দায়ের করতে হয় নির্বাচন আপীল ট্রাইবুনালে। নির্বাচনকে আদালত ‘কোয়াসি সিভিল ম্যাটার’ হিসেবে গণ্য করে। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, কোয়াসি সিভিল ম্যাটারে প্লেইন্ট (প্রাথমিক আবেদন) পরিবর্তন করা যায় না। সেক্ষেত্রে ইশরাক পরবর্তীতে প্লেইন্টে যে সংশোধন এনেছেন তা নীতি বহির্ভূত।
৫ আগস্টের পর এবছরের ২৭শে মার্চ ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম ২০২০ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনের ফল বাতিল করে বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করে রায় দেন। একই সাথে ফজলে নূর তাপসকে মেয়র করে আগের গেজেট বাতিল করা হয়। এরপর ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়ে গত ২২শে এপ্রিল চিঠি দেয় ইসি। এর মাঝে ২৫ এপ্রিল ইশরাক সিইসির সাথে সাক্ষাৎ করেন। পরে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত আসার আগেই ২৭ এপ্রিল রাতে গেজেট প্রকাশ করে ইসি।
দ্বিতীয়ত, ইশরাকের এ মামলায় নির্বাচন কমিশন শুনানিতে অংশগ্রহণ না করায় একপাক্ষিক রায় হয়েছে এবং পরবর্তীতে কমিশন আপিলও করেনি। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হলেও মতামত দেওয়ার আগেই এবং লিগ্যাল নোটিশ উপেক্ষা করে রাত ১০টায় গেজেট প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। যেহেতু স্থানীয় সরকার বিভাগ মেয়রকে শপথ পড়ায়, সেক্ষেত্রে উক্ত মামলায় স্থানীয় সরকারকে পক্ষভুক্ত করা প্রয়োজন ছিলো। এখানে স্থানীয় সরকার বিভাগ পক্ষভুক্ত না থাকায় এবং রায়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতি কোনো নির্দেশনার উল্লেখ না থাকায় শপথ পড়াতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এমনকি শপথ না দেওয়ার কারণে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার বিভাগকে বিবাদী করে রিট পিটিশন দায়ের করা হয়েছে, যা এখনো বিচারাধীন রয়েছে।
একই সময়ে বরিশাল সিটি করপোরেশন সংক্রান্ত মামলায় আর্জি সংশোধন সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়কে আমলে নিয়ে খারিজ করেছে ট্রাইব্যুনাল। চরমোনাই পীর সাহেবের প্লেইন্ট সংশোধন খারিজ করে দিলেও ইশরাকের সংশোধিত প্লেইন্টের পক্ষে রায় দেয়ায় ট্রাইব্যুনালের দ্বিমুখী অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার বিভাগের দৃষ্টিভঙ্গি
আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল। নির্বাচন কমিশন তো একটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের মতামত জানার আসলে প্রয়োজন ছিল না। ওনাদের সিদ্ধান্ত ওনাদেরই নেয়ার কথা।’
“আমাদের কাছে যখন মতামতের জন্য পাঠিয়েছিলেন, তখন আমরা সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছিলাম। কথা বলে আমরা যেটা জেনেছিলাম যে, নির্বাচনি যে প্লেইন্ট (প্রাথমিক আবেদন) আছে সেটা নাকি পরিবর্তন করা যায় না। কারণ হাইকোর্টের রায় আছে এটা নাকি কোয়াসি সিভিল ম্যাটার। কোয়াসি সিভিল ম্যাটারে প্লেইন্ড পরিবর্তন করা যায় না”, যোগ করেন তিনি। ইশরাক সাহেব নাকি প্লেইন্ট পরিবর্তন করেছিলেন। এ জন্য আমরা একটু দ্বিধান্বিত ছিলাম যে গেজেট নোটিফিকেশন হবে নাকি এটা নিয়ে আপিল করতে হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন আমাদের মতামতের জন্য অপেক্ষা করেন নাই।’
এদিকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘যেহেতু নানা ধরনের আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছে, মেয়াদ সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হয়েছে, এই জটিলতা নিরসনে আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছি। আদালতে আইনি লড়াই লড়তে হবে এবং যে জটিলতাগুলো আছে সেগুলো নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের ভিত্তিতে আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারবো।’
নির্বাচনের বৈধতার প্রশ্ন
স্থানীয় সরকার বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ওই নির্বাচনে মাত্র ৩০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ওই নির্বাচন নিয়েও ছিল নানা প্রশ্ন। ইশরাক নিজেও এ নির্বাচনের ফলাফল বাতিল চেয়েছিলেন। কাজেই একই নির্বাচনকে জালিয়াতি বলে দাবি করে পুনরায় সে নির্বাচনের ফলাফলের প্রেক্ষিতে মেয়র পদ দাবি করা নির্বাচনের বৈধতার প্রশ্নকে দুর্বল করে দেয়।
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান এর মতে, ‘শুধু মেয়র দিয়ে তো সিটি কর্পোরেশন চলে না। ওই নির্বাচনে যারা কাউন্সিলর হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলেন, তারা যদি এখন একই ধরনের রায় চায় তাদের ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত হবে? এই ধরনের নির্বাচনে কেউ যদি মেয়র পদে বসেন তাহলে বিগত সরকারের সময়ের নির্বাচনগুলোর বৈধতার প্রশ্নগুলোও সামনে আসবে।’
মেয়াদের প্রশ্ন
আইন অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র পদের মেয়াদ রয়েছে আগামী ১৫ই মে পর্যন্ত। ইসির গেজেটের পর এই পদে শপথ নিলে তার মেয়াদকাল কতদিন হবে সেটি নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। শূন্য পদের বিপরীতে উপ-নির্বাচন না দিয়ে কাউকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করে ইসির গেজেটের পর প্রশ্ন উঠেছে এই পদে ইশরাক হোসেন কতদিন দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ এর মতে, ‘বর্তমান আইন অনুযায়ী এই সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ শেষে যদি নতুন করে তফসিল ঘোষণা করা হয়, সেখানে যদি ইশরাক হোসেন প্রার্থী হতে চান তাহলে তাকে এই সময়ের মধ্যেই পদত্যাগ করে পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হতে হবে।’
আর যদি এই সময়ের মধ্যে নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করা হয় তখন কি হবে? এমন প্রশ্নে অধ্যাপক আহমেদ বলেন, ‘বর্তমান আইনে এই বিষয়গুলো নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা নাই। তবে স্থানীয় সরকার কমিশন নতুন যে সংস্কার প্রস্তাব করেছে সেখানে মেয়াদ শেষে ভোট না হলে প্রশাসক বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।’ তার মতে, এমন ঘটনা এর আগে ঘটেনি। যে কারণে এখন শপথ নিলে ইশরাক হোসেন কতদিন পদে থাকতে পারবেন তা নিয়ে একটা আইনগত জটিলতা রয়েই গেছে।
সম্ভাব্য সমাধান
এদিকে ইশরাককে মেয়র ঘোষণার দাবিতে টানা কর্মসূচি পালন করছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। ইশরাক হোসেন সমর্থকদের এই কর্মসূচিতে সমর্থন জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নও। বুধবার সকাল ১০টার মধ্যে ইশরাকের শপথের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছে তারা। ওই সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে তারা কর্মবিরতিরও ঘোষণা দিয়েছেন।
এসব জটিলতার জন্য ইশরাকের সমর্থকরা একতরফা দায়ী করছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদকে। আসিফ মাহমুদের কুশপুত্তলিকায় জুতা নিক্ষেপ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একহাত নিয়েছেন তারা। বিপরীতে আসিফ মাহমুদও বিদ্যমান আইনী প্রশ্নগুলো সমাধান করে আসতে বলেছেন। বিষয়টি বিএনপি ও এনসিপির শীতল দ্বন্দ্বযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। এমনকি ইশরাক ছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগও দাবি করেছেন। তবে বিএনপি ও এনসিপির এ ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’তে কোন পক্ষই আপাত ছাড় দিতে রাজি না। ইশরাকের মেয়র ইস্যুকে কেন্দ্র করে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করতে পারে বিএনপি।
আবার আইনী প্রশ্ন থেকে যাওয়ায় যদি ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করা হয়, তাহলে একই রায়কে কেন্দ্র করে যদি সারাদেশে বিগত নির্বাচনের কাউন্সিলর প্রার্থীরা নিজেদের কাউন্সিলর ঘোষণার দাবি জানায়, তাহলে তা কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। একই ইস্যুতে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে চরমোনাই পীরকে মেয়র ঘোষণা করতে হবে।
সর্বশেষ মেয়াদের প্রশ্ন তো থেকেই যায়। কাজেই অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের হাতে সবচেয়ে ভালো সমাধান হচ্ছে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগ পর্যন্ত ইশরাককে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া। আপাত বিএনপিকে যত কম চটানো যায় সেটাই সরকারের পক্ষে সুবিধাজনক।
Discussion about this post