সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে আপিল বিভাগের রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ওপর কড়া সমালোচনা করেছেন মন্ত্রী-সাংসদেরা।
আজ বুধবার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ষোড়শ সংশোধনীর রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে আলোচনার সময় মন্ত্রী-সাংসদেরা এ সমালোচনা করেন। এ সময় অনেকেই অভিযোগ করেন, প্রধান বিচারপতি একাধিকবার শপথ ভঙ্গ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগও আনেন। প্রধান বিচারপতির দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণ থাকার কথা উল্লেখ করে কেউ কেউ বলেন, প্রধান বিচারপতিকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁর দুর্নীতির তদন্ত হওয়া উচিত।
জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭(১) ধারায় সংসদে নোটিশ দেন জাসদের (একাংশ) সাংসদ মইন উদ্দীন খান বাদল। তাঁর প্রস্তাবে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় বাতিলের জন্য যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রস্তাব পাস করার প্রস্তাব করেন তিনি। তাঁর এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী-সাংসদেরা আদালতের রায় নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন।
সাংসদদেরা প্রধান বিচারপতির পাশাপাশি ওই মামলায় আপিল বিভাগে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে থাকা ব্যক্তিদেরও ব্যাপক সমালোচনা করেন।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, প্রধান বিচারপতি রায়ে বলতে চেয়েছেন, বাংলাদেশ অকার্যকর রাষ্ট্র। এমন সময়ে তিনি এটা বলছেন, যখন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এ রায় দিয়ে তিনি বিএনপিকে উৎফুল্ল করার চেষ্টা করেছেন।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, জনগণ সব ক্ষমতার উৎস। সংসদ সদস্যরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। সংসদকে কেউ ছোট করলে পুরো জাতিকে ছোট করা হয়। সংসদকে অপরিপক্ব বলার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতিরা পরিপক্ব। আর আমরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিতরা অপরিপক্ব!’
প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বেশি কথা বলা ভালো না। তিনি সেদিন বলেছেন, ‘‘আমাকে মিস কোট করা হয়েছে।’’ মিসকোট কাকে করা হয়? যে বেশি কথা বলে। দেশে এতজন প্রধান বিচারপতি ছিলেন, কাউকে নিয়ে এত বিতর্ক হয়েছে?’
উচ্চ আদালত থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে এক বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত না করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি তদন্ত করতে পারবে। কিন্তু বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত করা যাবে না?
অ্যামিকাস কিউরিদের সমালোচনা করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, তাঁরা কারা? ড. কামাল আওয়ামী লীগ-প্রধানমন্ত্রীবিরোধী। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। রোকনউদ্দিন মাহমুদ হাইকোর্টে এক কথা বলেছেন, আপিল বিভাগে আরেক কথা বলেছেন। মোহাম্মদ আলী, তিনি দৌড় আলী নামে পরিচিত। হাসান আরিফ বিএনপির নিযুক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, ফিদা কামাল সেনা-সমর্থিত সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া বিএনপির আমলে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, টি এইচ খান বিএনপির মন্ত্রী। তিনি প্রশ্ন রাখেন, নিরপেক্ষ বা আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কোনো আদালতের বন্ধু পাওয়া গেল না?
অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্য করা হয়েছে মন্তব্য করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বিস্মিত হই, অবাক লাগে, প্রথম আলোতে সাক্ষাৎকার দেখলাম ড. কামাল হোসেনের। তিনি বলেছেন, আমাদের সংবিধান শুরু হয়েছে “আমরা” দিয়ে। হঠাৎ এই প্রশ্ন আসল কেন? তিনি কি জানেন না, স্বাধীনতার ঘোষণা শুরু হয়েছিল “আমি” দিয়ে?’
শেখ ফজলুল করিম সেলিম প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। আপনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। আপনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা যেতে পারে।’ বিষয়টি দেখার জন্য তিনি আইনমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধও জানান।
শেখ সেলিম বলেন, এই রায় আপনাকেই বাতিল করতে হবে। না করলে আপনার বিরুদ্ধে কী করা হবে, তার জন্য অপেক্ষা করেন। তিনি এস কে সিনহার উদ্দেশে আরও বলেন, সময় আছে শুধরে যান, জনগণের কাছে ক্ষমা চান। না হলে সংসদের ক্ষমতা কী, বুঝতে পারবেন।
প্রধান বিচারপতি আদালতকে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম বানিয়েছেন অভিযোগ করে শেখ সেলিম বলেন, ‘পদত্যাগ করে রাজনীতি করেন। দেখবেন জনগণ খায়েশ মিটায়ে দেবে।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, প্রধান বিচারপতি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। তাঁর দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণ আছে। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এসব নিয়ে সংবাদও হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে মামলা চলাকালে সাকা চৌধুরীর স্ত্রী বিদেশে ও বাসভবনে এস কে সিনহার সঙ্গে দেখা করেছেন। এতে তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘বঙ্গবন্ধু একক নেতা না, তাহলে তাঁর (প্রধান বিচারপতি) কোন ঠাকুর একক নেতা?’
স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা তুলে ধরে মোজাম্মেল হক বলেন, প্রধান বিচারপতি আত্মস্বীকৃত শান্তি কমিটির সদস্য। আদালতে তিনি নিজেই তা স্বীকার করেছেন। একজন আত্মস্বীকৃত পিস কমিটির সদস্য বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে না-ই জানতে পারেন।
প্রধান বিচারপতি উসকানি দিয়েছেন অভিযোগ করে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আবার বলেন, ‘‘দেখেন নাই পাকিস্তানে কী হয়েছে?’’ কত বড় দুঃসাহস তাঁর!’
রায়ের পর্যবেক্ষণ বাতিলের দাবি জানিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, সর্বোচ্চ আদালত তাঁর এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে রায় দিয়েছেন। এই রায় বারবার দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তিনি বলেন, রায়ে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন সম্পর্কে অস্বীকার নয় শুধু বিদ্রূপ করার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমান সরকার ও নেতৃত্ব সম্পর্কে অযাচিত মন্তব্য করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির পাকিস্তানপ্রীতির পেছনে আর কিছু আছে কি না দেখা দরকার।
সংসদে প্রস্তাব তুলে ধরার পর প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে মইন উদ্দীন খান বাদল বলেন, ‘কোন অধিকারে বাতিল করলেন? জনগণের কাছে আপনাকে উত্তর দিতে হবে।’ তিনি বলেন, তাদের কাছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য অস্ত্রধারী উত্তরপাড়াই উত্তম। প্রধান বিচারপতি প্রমাণ করতে পারবেন না এই সংসদ বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। এ জন্যই তিনি আইনি পয়েন্ট থেকে সরে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন, যা বলার অধিকার তাঁর নেই।
বিচারপতিদের উদ্দেশে বাদল বলেন, ‘রায়ের মধ্য দিয়ে আপনারা আপনাদের চেহারা উন্মোচন করেছেন। সে চেহারা জনগণকে প্রচণ্ড দুঃখ দেবে।’
ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, সংবিধান সংশোধন করার কোনো অধিকার আদালতের নেই। এই রায় অসাংবিধানিক। সুপ্রিম কোর্টও সংবিধানের ঊর্ধ্বে নন। সংসদ সার্বভৌম, আদালত নন।
শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, বিচারক নিয়োগের আইন ও সুষ্ঠু পদ্ধতি না থাকায় এই জটিলতা এবং এই রায় এসেছে। তাঁর দাবি, বাংলাদেশে এখন সুপ্রিম কোর্ট বলে আসলে কিছু নেই। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ আছে। আপিল বিভাগ আপিলের বাইরে অন্য কোনো রায় বা পর্যবেক্ষণ দিতে পারেন না। তাঁদের সে অধিকার নেই। সংসদও এই রায় মানতে বাধ্য নয়।
মুজিবুল হক বলেন, একটি পত্রিকা এই রায় ঠিক আছে, তা প্রতিষ্ঠিত করতে বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছে। কেন, তা তিনি জানেন না।
স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী দাবি করেন, এই সংসদের মতো প্রাণবন্ত ও বিতর্কপ্রবণ সংসদ ১৯৭৩-এর পর আর দেখা যায়নি।
দীপু মনি, ফখরুল ইমাম, ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী, তাহজীব উল আলম সিদ্দিকী প্রমুখ বক্তব্য দেন।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post