মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে চলমান আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের শেষ পর্বের শুনানিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এ আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, কাচিন, কারেনসহ কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা এ অভিযোগ আনেন। আদালতে রোহিঙ্গারা বলেন, মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনী জাতিগত নিধন অভিযান চালাচ্ছে।
ওই গণ-আদালতে আমন্ত্রিত বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকেও রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতনের প্রমাণ তুলে ধরা হয়। আদালতে কমিশনের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেন এর চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি ওই আদালতে চলা শুনানির অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আজ বুধবার প্রথম আলোকে এসব কথা বলেন।
রোমভিত্তিক পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) নামের একটি সংগঠন এই আদালত গঠন করে। পিপিটি ষাটের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পটভূমিতে প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের ধারণায় প্রতিষ্ঠিত। এর যাত্রা শুরু ইতালির বোলোগনাতে, ১৯৭৯ সালে। কুয়ালালামপুরের মালয় ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সিভিলাইজেশন ডায়ালগের পরিচালক ও বুদ্ধিজীবী চন্দ্র মোজাফফর পিপিটির এই বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে সমন্বয় করেছেন। মালয় ইউনিভার্সিটির আইন অনুষদেই এই বিচার চলছে। আগামী শুক্রবার এর রায় দেওয়া হবে।
এ আদালতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ সরকারকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। সরকারের পক্ষ থেকে মানবাধিকার কমিশনকে এ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় বলে কমিশন সূত্র জানায়।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক বলেন, ‘আমি রোহিঙ্গা ও কাচিন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বক্তব্য শুনেছি। তাঁরা সবাই একবাক্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বর নিপীড়নের নানা চিত্র তুলে ধরেন। তাঁরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনেন। রোহিঙ্গারা রাখাইনে চলমান অভিযানকে জাতিগত নিপীড়ন হিসেবে তুলনা করেন।’
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির বিরুদ্ধে শুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা কী বললেন?
জবাবে রিয়াজুল হক বলেন, ‘সবাই সু চির প্রতি চরম ক্ষোভ দেখান। তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ আনেন রোহিঙ্গারা। রাখাইনে চলমান সেনা অভিযান ও নিপীড়ন সু চির অবস্থানের প্রতি ঘৃণা জানান তাঁরা। একজন রোহিঙ্গা প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা তাঁর মুক্তির আন্দোলন করেছি। তাঁর বাবার সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষেরা লড়াই করেছেন। আমরা দেশে ভোট দিয়েছি। অথচ আমাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করা হয় না। আর এ নিয়ে সু চি কিছু বলেন না।’
গত ৯ থেকে ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি দল কক্সবাজারের কুতুপালংসহ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করে। রিয়াজুল হকের নেতৃত্বে এই পরিদর্শন হয়। এ দলের উদ্দেশ্য ছিল ভুক্তভোগী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে সেখানকার অবস্থার তথ্যানুসন্ধান করা। সেই তথ্যানুসন্ধানের প্রাথমিক প্রতিবেদন কুয়ালালামপুরে চলা গণ-আদালতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে বক্তব্য তুলে ধরেন রিয়াজুল হক। তিনি বলেন, ‘আমরা নারী-পুরুষ-শিশুসহ অসংখ্য মানুষের কথা শুনেছি। তাঁরা তাঁদের প্রতি বর্বর অত্যাচারের কথা বলেছেন। বলেছেন, কীভাবে তাঁদের চোখের সামনে নিজেদের আত্মীয়দের হত্যা করতে দেখেছেন। এসব কথা আমরা বলেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এসব চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপ তুলে ধরেছি।’
ওই পরিদর্শনের ওপর ভিত্তি করে আট মিনিটের একটি তথ্যচিত্র আদালতে তুলে ধরা হয়।
এ আদালতে নয় সদস্যের বিচারকের একটি প্যানেল শুনানি গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারসের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও আর্জেন্টিনায় সেন্টার ফর জেনোসাইডের প্রতিষ্ঠাতা দানিয়েল ফিয়েরেস্তেইন, আয়ারল্যান্ডের ডেনিস হেলিডে, ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ তদন্ত-প্রক্রিয়ায় যুক্ত মালয়েশিয়ার জুলাইহা ইসমাইল, কম্বোডীয় আইনবিদ হেলেন জার্ভিস, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির মেকুইয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক প্রধান গিল এইচ বোয়েরিঙ্গার, ইন্দোনেশিয়ার মানবাধিকার আইনজীবী নুরসিয়াবানি কাতজাসুংকানা, ভারতের মুম্বাই দাঙ্গার তদন্তকারী ও দেশটির সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি বেলুর নারায়ণস্বামী শ্রীকৃষ্ণ, ইরানের মানবাধিকার আইনজীবী সাদি সদর এবং ইতালির সুপ্রিম কোর্ট অব ক্যাসেসনের বর্তমান সলিসিটর জেনারেল নিলও রেসি।
পিপিটি সূত্র জানায়, মিয়ানমারে গণহত্যা নিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল এ বছরের মার্চে প্রথম শুনানির আয়োজন করে। এবার চূড়ান্ত শুনানি চলছে।
কুয়ালালামপুরের আদালতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিব হিরণ্ময় বাড়ৈ এবং উপপরিচালক এম রবিউল ইসলামও অংশ নেন।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post