জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, “হিন্দু না ওরা মুসলিম? এই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র”।
যেখানে চলছে নারী-শিশু-পুরুষ নির্বিশেষে গণহত্যা ও নির্যাতন। সেখানে প্রশ্ন শুধুই মানবতার। নির্যাতিত রোহিঙ্গা হিন্দুদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে উখিয়ার মুসলিম আলেমেরা। ইসলাম যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, তা দেখিয়ে দিয়েছেন তারা। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে তাদের কাছে হিন্দু কিংবা মুসলিম পরিচয় একেবারেই গৌণ। তারা নিপীড়িত রোহিঙ্গা হিন্দুদের শুধু ত্রাণ নয় বরং তাদের খোঁজ খবরও নিচ্ছেন নিয়মিত।
মঙ্গলবার সকালে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় হিন্দু রোহিঙ্গাদের মাঝে মুসলিম আলেমদের ত্রাণ বিতরণের এই দৃশ্য দেখা গেছে। উখিয়ার ভালুকিয়াপালং জামে মসজিদের খতিব মওলানা নুরুল আলম ও মওলানা হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে একদল আলেম হিন্দুদের মাঝে ত্রাণের প্যাকেট তুলে দেন। মুসলিমদের ত্রাণ সহায়তা পেয়ে হিন্দুরা ভীষণ খুশি। নির্যাতনের শিকার সুরধন পাল স্ত্রী বিনাবালাকে নিয়ে রাখাইনের মংড়ুর চিকনছড়িপাড়া থেকে উখিয়ায় কুতুপালংয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
আলেমদের ত্রাণের প্যাকেট হাতে পেয়ে সুরধন পাল বলেন, রোহিঙ্গা আগমনের শুরুতে উখিয়া টেকনাফের মুসলমানরা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে না দাঁড়ালে অনেকে না খেয়ে মারা যেত। তারা যেভাবে ছুটে এসেছেন, আমরা হিন্দুরা তাদের ধন্যবাদ জানাই।
মাওলানা নুরুল আলম বলেন, আমাদের সামাজিক সংগঠন ‘সূর্যোদয় সংঘের’ মাধ্যমে আমরা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মাঝে নিয়মিতভাবে সহযোগিতা দিচ্ছি। তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গারা আসার পর শুরুতে তাদের সাহায্য করার মতো তেমন কেউ ছিল না। সেসময় উখিয়া টেকনাফের মানুষেরা তাদের ভাত রান্না করে খাইয়েছে,পানি দিয়েছে। ইসলামের শিক্ষাই হচ্ছে মানবতার সেবা, এখানে হিন্দু মুসলমান কোনো প্রশ্ন নয়।
প্রায় পাঁচ শতাধিক নির্যাতিত রোহিঙ্গা হিন্দু আশ্রয় নিয়েছে উখিয়ার কুতুপালংয়ের ৯নং ওয়ার্ডের পশ্চিম হিন্দুপাড়া গ্রামে। তাদের আশ্রয় দিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দা আশিষ শর্মা। তিনি তার মুরগির খামার খালি করে তাদের আশ্রয় দিয়েছেন।
সুরধন পাল জানান- মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে থাকা কালাপার্টি (মুখোশ পরিহিত) তাদের ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। সেনা সদস্যরা আমাদের ঘর ঘেরাও করে বলে,তোমরা মাল চাও নাকি জীবন চাও? ভয়ে আমরা পালিয়ে আসি। তিনি আরো বলেন, আমরা প্রাণে রক্ষা পেলেও অনেক হিন্দুদের হত্যা করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতিচারণ করে হিন্দু নারী বিনাবালা বলেন, ২৭ আগস্ট সকালে মিয়ানমারের মংডু জেলার ফকিরা বাজার গ্রাম দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। এই ভয়াবহ আগুন দেখে ভয়ে হতভম্ব হয়ে পড়ে এলাকাবাসী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলির শব্দ। সেইসঙ্গে সেনাবাহিনীর সাথে উগ্র বৌদ্ধরা হামলা চালায় গ্রামবাসীর ওপর। ফকিরা বাজার এলাকার জুয়েলারির দোকানে হামলা চালিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকজনকে। লুট করা হয় স্বর্ণালংকার।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রুবেল পাল বলেন, ‘আমার বাড়ি চিকনছড়িপাড়ায় কিন্তু আমি ফকিরা বাজারে এক সেলুনে নাপিতের কাজ করতাম। মিয়ানমার সেনাদের নির্যাতন ও গণতহত্যা দেখে পরিবারের আট সদস্যের সঙ্গে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসি।
রোহিঙ্গা নিধনের এই অভিযানে দেবরকে হারিয়েছেন মংডুর চিকনছড়িপাড়ার বাসিন্দা মালতিবালা। মালতি বলেন, এই হত্যার দৃশ্য মনে পড়লে আমার এখনও ভয় হয়।
হিন্দুরা জানায়, ফকিরা বাজার জ্বালিয়ে দেওয়ার খবর পেয়ে সকাল ১০টার মধ্যে গ্রাম ছাড়ে চিকনছড়িপাড়ার বাসিন্দারা। একের পর এক হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ঘটনায় তারা সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাখাইনের লুম্বাশিয়া পাহাড়ে আশ্রয় নেন। এরপর মুসলিমদের স্রোতের সাথে মিশে তারা বাংলাদেশে আসতে সক্ষম হয়।
হিন্দু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া আশিষ জানান, এখানে হিন্দুদের এখন অনেকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। মুসলিমাদের পাশাপাশি সনাতন ধর্মের লোকজনও আসছেন সাহায্য নিয়ে।
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post