বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে ধারাবাহিক আলোচনায় করছে। লক্ষ্য আগামী সাধারন নির্বাচন।
নির্বাচন কমিশন যখন এ ধরনের আলোচনা করছে, তখন প্রধান বিচারপতির সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাথে সরকারের দ্বন্দ্ব নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
মি: সিনহা দায়িত্ব পালনের বিভিন্ন সময় বলেছেন, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে।
উচ্চ আদালতে সরকারের হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়ে যখন তীব্র আলোচনা এবং বিতর্ক চলছে, তখন স্বাভাবকিভাবেই প্রশ্ন উঠে আরেকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে?
গত ২৫ বছরে এ প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা নিয়ে বিস্তর আলোচনা এবং বিতর্ক হয়েছে।
২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেনাবাহিনী মোতায়েন করার।
সেজন্য সরকারকে চিঠিও দিয়েছিল। কিন্তু সরকার সে চিঠির উত্তরই দেয়নি। কারণ সরকার চায়নি সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হোক।
হতাশ ও ক্ষুব্ধ নির্বাচন কমিশন বলেছিল, নির্বাচনে গোলযোগ হলে তাদের কোন দায় নেই।
সে সময় নির্বাচন কমিশনার ছিলেন সাখাওয়াত হোসেন। মি: হোসেন বলছিলেন, বিষয়টি নিয়ে তখন নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল।
“আমরা শেষ মুহূর্তে এসে দেখলাম যে গর্ভমেন্টের দিক থেকে আমাদের সাথে টোটাল নন-কোঅপারেশন এ বিষয়ে। সংবিধানে বলা আছে যে নির্বাচন কমিশন যে ধরনের সহায়তা চাইবে সেটা দিতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু সরকারের দিক থেকে সহায়তা না থাকলে একটা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কাজ করতে বেশ সমস্যা হয়,” বলছিলেন সাখাওয়াত হোসেন।
এটি একটি উদাহরণ মাত্র। ক্ষমতাসীনরা সবসময় বলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। অন্যদিকে বিরোধীপক্ষ বলে সেটির উল্টো।
১৯৯৪ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময় মাগুরা জেলায় একটি উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত মেয়াদ শেষ হবার আট মাস আগেই পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুর রউফ।
২০০৭ সালে সরে যেতে হয়েছিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এম এ আজিজ সহ পুরো কমিশনকে।
আবার অনেকে মেয়াদ পূর্ণ করলেও বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজের সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিল না।
বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করছেন ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আব্দুল আলীম।
তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন, নির্বাচন কমিশন কাঠামোগতভাবে এবং আর্থিকভাবে স্বাধীন। কিন্তু অপারেশনালি নির্বাচন কমিশন স্বাধীন কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
তাছাড়া বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কোন আইন নেই। আইন না থাকায় কারা নির্বাচন কমিশনার হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন যোগ্যতা নির্ধারণ করা নেই।
ফলে নিয়োগের প্রথম থেকেই সরকারের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থেকেই যায় বলে মনে করেন মি: আলীম।
স্বাধীনতার পর থেকে অধিকাংশ নির্বাচন কমিশন বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেনি।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের উপর প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি কোন একটি সরকারের বিষয় নয়।
বিভিন্ন সরকার এ ধরনের কাজ কমিশনের উপর ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ এবং কর্তৃত্বের বেশি অভিযোগ উঠে স্থানীয় নির্বাচনের সময়।
কিন্তু বিভিন্ন সময় সরকার কেন নির্বাচন কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়?
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাংলাদেশে পলিটিকাল পার্টি হেরে গেলে তারা শুধু ক্ষমতাচ্যুত হয় না, তারা নানান ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।
ফলে ক্ষমতায় থাকার জন্য ইলেকশনে জিততে হবে। সেজন্য ইলেকশন জিততে তারা যত রকমের প্রক্রিয়া অবলম্বন করা দরকার তার সব কিছু করে।
বিশ্লেষকরা বলেন, বিভিন্ন সময় দেখা গেছে ক্ষমতাসীনরা যেভাবে চিন্তা করে নির্বাচন কমিশনও একইভাবে ভাবে।
মি: সাখাওয়াত হোসেন যে নির্বাচন কমিশনে ছিলেন তারাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেনি।
তখন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মনোভাব অনুযায়ী ‘মাইনাস টু ফর্মুলার’ আলোকে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির মূলধারাকে বাদ দিয়ে সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত অংশকে সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানায় নির্বাচন কমিশন।
এনিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল তারা। তারা মনে করেন, সরকার না চাইলে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা রীতিমতো অসম্ভব।
কারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারী কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় নির্বাচন কমিশনকে।
সেজন্য নির্বাচন কমিনের স্বাধীনতার সাথে সরকারের সহযোগিতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সে বিষয়টি বলছিলেন, ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের আব্দুল আলীম।
গত বছর নারায়নগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু হিসেবে বিবেচনা করেন পর্যবেক্ষকরা।
সে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর তেমন কোন আপত্তি ছিল না। কাজী রকিব উদ্দিনের নির্বাচন কমিশন সে নির্বাচন পরিচালনা করেছিল।
অথচ একই নির্বাচন কমিশনের অধীনে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম এবং জালিয়াতির অভিযোগ উঠে। বিশ্লেষকরা বলেন, সরকার যে নির্বাচনটি সুষ্ঠু করতে চেয়েছিল সেটি সুষ্ঠু হয়েছিল।
আর যেটি চায়নি সেটি সুষ্ঠু হয়নি। বিশ্লেষক ড. তোফায়েল আহমেদ বলছেন, সরকারের দিক থেকে কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে , সেটি যদি কমিশন মেনে নিয়ে নিশ্চুপ তাহলে প্রশ্ন উঠবেই।
কমিশন তার সাধ্যমতো চেষ্টা করলে সরকারের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা কমে আসতে পারে।
মি: আহমেদ বলেন, নির্বাচন পরিচালনায় সরকারের এবং নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা হওয়া উচিত ‘সম্পুরক এবং পরিপূরক’।
“নির্বাচন কমিশন রেফারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। সরকারের সহায়তা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতি এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ভূমিকা – সবকিছু মিলিয়ে এটা যৌথ কর্মযজ্ঞ,” বলছিলেন তোফায়েল আহমেদ।
নির্বাচন পরিচালনার সময় নির্বাচন কমিশন যদি সরকারের কাছ থেকে কোন অসহযোগিতা দেখ তাহলে সেটি তাদের পরিষ্কার করে বলতে হবে বলে মনে করেন মি: আহমেদ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা গেছে, যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে তারা দাবী করেন নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। অন্যদিকে বিরোধী দল নির্বাচন কমিশনের সমালোচনায় মুখর থাকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী সরকার নির্বাচন কমিশনকে সবধরনের সহায়তা করবে।
নুরুল হুদার নেতৃত্বে বর্তমান নির্বাচন কমিশন গত ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা শুরু করলেও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ছাড়া তাদের সামনে এখনো বড় ধরনের নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ আসেনি।
সামনে চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং সংসদ নির্বাচন তাদের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষার মতো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এরই মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে প্রমাণ করতে হবে তারা আসলে কতটা সরকারের প্রভাবমুক্ত।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
Discussion about this post