রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে সেটাকে ‘স্টান্টবাজি’ অভিহিত করেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের শীর্ষ এক কর্মকর্তা। নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটির শরণার্থী অধিকারবিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রেলিক বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের ভস্ম হয়ে যাওয়া গ্রামগুলোতে মিয়ানমার এখন তাদের দুই হাত প্রসারিত করে ফেরত নেবে এমন ধারণা হাস্যকর।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি সম্পর্কের এ স্টান্টবাজিতে সমর্থন না দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এটা পরিষ্কার করতে হবে যে, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকগুলো ছাড়া কোনো প্রত্যাবাসন হবে না। ফেরত যাওয়া ব্যক্তিদের শরণার্থী শিবিরে রাখার ধারণার ইতি টানতে হবে। এছাড়া জমিজমা ফেরত দেয়া এবং ধ্বংস করা বাড়িঘর, গ্রাম পুনর্গঠনসহ আরও অনেক শর্ত দিতে হবে।’
বিল ফ্রেলিক বলেন, ‘এগুলো করা হলেও, মিয়ানমার সেনাবাহিনী যদি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কয়েক দশকের নির্যাতন ও বৈষম্যের চর্চাকে পাল্টানোর বিরাট কাজটা শুরু না করে, তাহলে স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে বহু রোহিঙ্গার মধ্যে পর্যাপ্ত আস্থা তৈরি করা কঠিন হবে।’
রয়টার্স জানায়, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২ মাসের মধ্যে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। বৃহস্পতিবার দেশ দুটির মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। তবে এ স্মারকে প্রত্যাবাসনের ধরন নিয়ে এবং এক্ষেত্রে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের কোনো ভূমিকা থাকবে কিনা বা থাকলেও তার রূপরেখা কি তার উল্লেখ নেই।
ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র আন্দ্রেজ মেহেসিস বলেন, স্বেচ্ছায় শরণার্থী প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে সাধারণত জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা জড়িত থাকে, যাতে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বজায় থাকে। কিন্তু চুক্তিতে সে রকম কিছু দেখিনি।’
এদিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পরিকল্পিত পন্থায় রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে ব্যাপকতর নিপীড়নের ঘটনাগুলো বাস্তবায়ন করেছে বলে মনে করছে জাতিসংঘ। নিপীড়ন বাস্তবায়নের এ পরিকল্পিত পথকে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ আর গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন জাতিসংঘের দূত প্রমিলা পাটেন। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেছেন। খবর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের।
যুদ্ধে যৌন সহিংসতাবিষয়ক জাতিসংঘের দূত প্রমিলা পাটেন গত মাসে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন। জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান যায়েদ রাদ আল হুসেনের সঙ্গে পুরোপুরি একমত পোষণ করে তিনিও একে ‘জাতিগত নিধন’ বলে অভিহিত করেন। সংবাদ সম্মেলনে পাটেন বলেন, যৌন সহিংসতার ব্যাপকতার কারণে মিয়ানমার থেকে ৬ লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। জাতি হিসেবে রোহিঙ্গাদের ধ্বংস ও বিতাড়িত করার একটি সুপরিকল্পিত অস্ত্র হিসেবে যৌন সহিংসতাকে ব্যবহার করা হয়েছে।
জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য কমাতে গঠিত জাতিসংঘ কমিটির সাবেক এ সদস্য জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকালে তাদের বিরুদ্ধে ঠাণ্ডা মাথায় সবচেয়ে হৃদয়বিদারক, দুঃখজনক ও ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা শুনেছেন তিনি। সেখানে শাস্তিস্বরূপ নারীদের দল বেঁধে ধর্ষণ, জোরপূর্বক নগ্ন করে রাখা ও যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে প্যাটেন জানান, রাখাইনে সবচেয়ে নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে নারী ও মেয়েদের পাথর বা গাছের সঙ্গে বেঁধে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে। অনেককে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। কিছু মেয়েকে তাদের বাড়িতেই ধর্ষণের পর ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনকি ২৫ আগস্টের আগেও মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা শিশুদের আগুনের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তারা যাতে পান করার পানি না পায় সেজন্য শিশুদের গ্রামের কূপগুলোর মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে।
সূত্র: যুগান্তর
Discussion about this post