স্বাধীনতার পর দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ ঘটে তৎকালীন বিডিআরের সদর দফতর পিলখানায়। আর এই হত্যা মামলায় সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে বিচারিক আদালত ১৫২ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেয়, যা বিশ্বের ইতিহাসে কোনও একটি মামলায় সবচেয়ে বেশি আসামির ফাঁসির রায়ের রেকর্ড।
অন্যদিকে একটি মামলায় একসঙ্গে ৫৭৫ জনকে শাস্তি প্রদান, একই ঘটনায় ৫৯টি মামলা দায়েরের ঘটনাও ইতিহাসে বিরল।
যদিও প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরাজিত শক্তির বাহিনীর অনেককে মৃত্যুদণ্ডের আসামি করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে কোনও মামলায় এত আসামিকে একসঙ্গে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের রায় আগে কখনও ঘটেনি।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর সদস্যদের হাতে ৫৭ জন কর্মকর্তাসহ সেনাবাহিনীর মোট ৭৪ জন সদস্য নিহত হন। বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) সদর দফতর পিলখানার ঘটনা সারাদেশের ৫৭টি ইউনিটে ছড়িয়ে পড়েছিল।
টানা একদিন-এক রাত কাটে দুর্ভাবনায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। আলামত মুছে ফেলতে গণকবর, লাশ পুড়িয়ে দেওয়া, এমনকি ম্যানহোলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
ওই ঘটনায় ১৫২ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন, ২৬২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড এবং অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২৭১ জনকে বেকসুর খালাস দিয়েছিল আদালত। চার জন আসামি বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় মামলার দায় থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়।
রাজধানীর বকশীবাজারের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ আদালতে মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এই রায় দিয়েছিলেন।
বিচারিক আদালতের রায়ের আগে যা ঘটেছিল
বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) সদর দফতর পিলখানায় সংঘটিত নৃশংস হত্যা ঘটনার পর তিন ধরনের তদন্ত শুরু হয়- বিডিআরের তদন্ত, সেনাবাহিনীর তদন্ত এবং জাতীয় তদন্ত। তদন্ত শেষে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কয়েকটি দাবি উত্থাপিত হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল, এই হত্যার বিচার সামরিক আইনে করা।
তবে বিচার প্রক্রিয়াকে সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি এগিয়ে আসেন। তিনি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে ২০০৯ সালের ১৭ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের কাছে এই বিচারের বিষয়ে মতামত চেয়ে একটি রেফারেন্স পাঠান। এরপর মতামত প্রদানের জন্য সুপ্রিম কোর্ট ১০ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন। তারা হলেন- ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, টিএইচ খান, মাহমুদুল ইসলাম, খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমাদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, এএফ হাসান আরিফ, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আজমালুল হোসেন কিউসি ও এএফএম মেসবাহউদ্দিন।
এই ১০ জন অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে সাত জনই সাংবিধানিক ও প্রচলিত বিভিন্ন আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে সেনা আইনে বিচার সম্ভব নয় বলে অভিমত দেন। তারা হলেন-ড. কামাল হোসেন, আমীর-উল ইসলাম, টিএইচ খান, মাহমুদুল ইসলাম, আজমালুল হোসেন কিউসি, এএফ হাসান আরিফ এবং এএফএম মেসবাহউদ্দিন।
তবে প্রজ্ঞাপন জারি করে সেনা আইনে বিচার করা সম্ভব বলে বিপরীত মত দেন- খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমাদ। এছাড়া, রফিক-উল হক তার মতামতে বলেন, ‘সেনা আইনে বিচার করা সম্ভব। তবে সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বাধা রয়েছে।’ কিন্তু রোকনউদ্দিন মাহমুদ কোনও মতামত না দিয়ে রেফারেন্স রাষ্ট্রপতির কাছে ফেরত পাঠানোর কথা বলেন।
এরপর অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে সুপ্রিম কোর্ট ২০০৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এই হত্যা মামলার বিচার সেনা আইনে সম্ভব নয় বলে রাষ্ট্রপতির কাছে মতামত পাঠায়।
পিলখানা ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর সিআইডির স্পেশাল সুপারেনটেনডেন্ট আবদুল কাহহার আকন্দ মামলাটি তদন্ত করেন। তাকে সহযোগিতা করেন পুলিশের ২০০ কর্মকর্তা। প্রায় ৫০০ দিন তদন্তের পর ২০১০ সালের ১২ জুলাই আদালতে হত্যা ও অস্ত্র বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। এতে ৮২৪ জনকে আসামি করা হয়। পরে অধিকতর তদন্তে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে বর্ধিত অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সব মিলে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৫০ জনে।
২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post