মিয়ানমার সফরের আগে রোমান ক্যাথলিকদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল রাখাইনে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ বলে সম্বোধন না করতে। মিয়ানমারের সেই অনুরোধ রেখেছিলেন পোপ। মিয়ানমার সফরকালে তিনি যেসব বৈঠক ও সভা সেমিনারে বক্তৃতা রেখেছিলেন কোথায়ও রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করেননি।
কিন্তু বাংলাদেশে এসে তিনি রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করবেন, এমনটাই আশা করেছিলো সবাই। আজ দুপুরে ঢাকায় পৌঁছানোর পর থেকে ব্যস্ত সময় কাটান পোপ ফ্রান্সিস। বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদের সঙ্গে। বঙ্গভবনে বক্তৃতাও করেন তিনি। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বললেও রোহিঙ্গা শব্দটি একটি বারের জন্যও উচ্চারণ করেননি তিনি।
মিয়ানমার সফরে দেশটির কার্ডিনাল চার্লস বো’র অনুরোধে সেখানে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি পোপ ফ্রান্সিস। স্থানীয় বৌদ্ধরাও রোহিঙ্গা শব্দ উচ্চারণ নিয়ে পোপকে হুমকি দিয়েছিল। মিয়ানমার সফর শেষে বাংলাদেশে এসেও শব্দটি ব্যবহার থেকে বিরত থাকলেন তিনি।
বঙ্গভবনে দেওয়া বক্তব্যে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, ‘গত কয়েক মাসে রাখাইন থেকে আসা বিশাল শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয় ও মৌলিক চাহিদা সরবরাহের মাধ্যমে মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ উদারতা ও সংহতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে।’
পোপ আরও বলেন, ‘মানুষের সীমাহীন ভোগান্তির পুরো পরিস্থিতি, শরণার্থী শিবিরগুলোতে থাকা আমাদের ভাই-বোন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু, তাদের জীবনের অনিশ্চিয়তার বিষয়টি বুঝতে আমরা ব্যর্থ হইনি।’ এ সময় রাখাইনের সংকটের সমাধান ও শরণার্থীদের ত্রাণ সহযোগিতার পাশাপাশি রাজনৈতিক সহায়তা দিতেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান পোপ।
পোপ রোহিঙ্গা উচ্চারণ না করলেও একই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ স্বাগত বক্তব্যে রোহিঙ্গা হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। সেখানে অনেক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে আর হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত নিষ্ঠুর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
এদিকে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘পোপ ফ্রান্সিস তার সদ্য সমাপ্ত মিয়ানমার সফরে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ না করায় এরই মধ্যে নানা সমালোচনা হচ্ছে’। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে, আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে শুরু হওয়া তিন দিনের ঢাকা সফরে তিনি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি মুখে আনবেন কি না। বাংলাদেশের প্রথম কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও বলছেন, এখানে পোপের রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করতে তিনি কোন আপত্তি দেখছেন না। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কার্ডিনাল ডি’রোজারিও বলেন, “উনি কি শব্দ ব্যবহার করবেন, তাতো আমি জানি না। তবে রোহিঙ্গা শব্দটি একটু সংবেদনশীল মনে হয় মিয়ানমারের জন্য। এটা রাজনৈতিক কারণে”।
পোপ এর আগে রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শব্দটি ব্যাবহার হচ্ছে। আমিও করেছি। এখনও করছি। বিকল্প কি বলব”? এমন সময় পোপ মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফর করছেন, যখন এই অঞ্চল কয়েক মাস ধরে রোহিঙ্গা সংকটে কাতর হয়ে আছে। ফলে স্বভাবতই বিশ্ববাসীর নজর ছিল, এই ইস্যুতে পোপের বক্তব্য কি হয়। কিন্তু আগেই মিয়ানমারের কার্ডিনাল চার্লস মোং বো পোপকে পরামর্শ দিয়ে রেখেছিলেন, সেখানে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার না করতে। শেষ পর্যন্ত ওই ‘পরামর্শ’ই অনুসরণ করেছেন পোপ। রাখাইন রাজ্যের মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ‘রোহিঙ্গা’ বলতে ঘোরতর আপত্তি রয়েছে মিয়ানমারের। অবশ্য সরকারিভাবে বাংলাদেশও এখন রোহিঙ্গা শব্দটি এড়িয়ে চলছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশ সরকার বলছে ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের অধিবাসী’। বাংলাদেশে আজ থেকে শুরু হওয়া তিন দিনের সফরে তিনি কেন কক্সবাজারে যাচ্ছেন না, সেটা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। এই প্রসঙ্গে কার্ডিনাল ডি’রোজারিও বলেন, পোপের সফরটির পরিকল্পনা অনেক আগে করা, সেসময় রোহিঙ্গা সংকট ছিল না। পোপের একটি সফর পরিকল্পনা করতে অনেক সময় লাগে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঘটনা ঘটেছে মাত্র ২৫শে অগাস্ট। কিন্তু ইতিমধ্যে সবকিছু পরিকল্পিত হয়ে গেছে। “এই সময়ে এটা সম্ভবপর ছিল না তার জন্য। আর বিষয়টাও তো অস্থির ছিল সরকারের জন্য…কাজেই ওই সময়ে সরকারের জন্য ওটা আয়োজন করা খুব কষ্টকর ছিল”। অবশ্য কক্সবাজার সফরে না গেলেও সেখান থেকে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দলকে ঢাকায় এনে পোপের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। জানা যাচ্ছে বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পোপের সাক্ষাতের অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের এই প্রতিনিধিদলটি পোপের সাক্ষাৎ পাবে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা ও শীর্ষনিউজ
Discussion about this post