প্রথমবারের মতো মঙ্গলবার ‘সুপ্রিমকোর্ট দিবস’ পালন হচ্ছে। এই দিসব পালনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের আধিপত্য ও হস্তক্ষেপ মুক্ত একটি পরিবেশ তৈরির আহবান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা। বিবৃতিতে, মাসদার হোসেন মামলার রায়ের মাধ্যমে যাতে অধঃস্তন আদালতকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগ সংবিধান ও সর্বোচ্চ আদালতে রায়ের প্রতি সম্মান দেখান-সে প্রত্যাশাও করেছেন।
এই সংবাদ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ.এফ. হাসান আরিফ ও ব্যারিস্টার ফিদা এম. কামাল।
সংবাদ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘১৯৭২ সালে ১৮শে ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধন করেন জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। এবারই প্রথম, সুপ্রিম কোর্ট দিবস পালিত হচ্ছে। এমন একটা সময়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে যখন এদেশের বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ অভিভাবক প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য। এই উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের সংবিধান এর অখন্ডতা রক্ষা, সমর্থন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এদেশের নাগরিকদের সকল মৌলিক অধিকার বলবৎ করার আদেশ বা নির্দেশ, সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার অংগীকারের পাশাপাশি সংবিধানের যে কোন অংশের সঙ্গে সঙ্গতিহীন কোন আইন বা সরকারি বিধি বা আদেশ যা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এমন কোন প্রশ্ন কিংবা জনগুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট এর গুরুত্বপূর্ণ রায় ও ঐতিহ্য গর্বের সাথে স্মরণ করছি।’
রায়গুলো ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ৭টি বিভাগীয় শহরে মহামান্য হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ গঠনের বিষয়ে প্রনীত সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বাতিল, সামরিক ফরমান জারি সংক্রান্ত সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশী কোম্পানীকে ১০০ বছরের জন্য লীজ প্রদান বাতিল, ২০০৭ সালের ১ কোটি ৪০ লাখ ভুয়া ভোটার বাতিল এবং সম্প্রতি সংসদ কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অপসারন সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা ও বাতিলের রায় সহ জনস্বার্থে দেওয়া অসংখ্য রায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব রায় সমূহের মাধ্যমে এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে জনগণের অধিকার রক্ষার্থে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ও ভারসাম্য কোন অবস্থাতেই পরিবর্তন ও ব্যত্যয় ঘটানো যাবেনা।
অধস্তন আদালতের বিচারকদের আলাদা শৃঙ্খলাবিধিসহ তিনিটি বিধির বিষয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি মাসদার হোসেন মামলার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি পুনঃ স্মরণ করতে গিয়ে দেখা যায় যে অধঃস্তন আদালতের ক্ষেত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিধি প্রণয়নে সংবিধানের মূলধারার বিচ্যুতি হয়েছে। এটা গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বকীয় অবস্থানের জন্য সংবিধান যে সুরক্ষা দিয়েছে তা সংরক্ষণ/বাস্তবায়ন করা সর্বোচ্চ আদালতের দায়িত্ব। দীর্ঘ ৪৬ বছর কালক্ষেপনের পর এই বিধিগুলো বর্তমানে অধঃস্তন বিচার বিভাগের জন্য সরকার সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৩৩ অনুযায়ী করেছে। অথচ ১৩৩ অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের জন্য প্রণীত হওয়ার বিষয়টি সংবিধানের কর্ম বিভাগের জন্য প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, অধঃস্তন আদালতে বিচার বিভাগীয় পদে নিয়োগ, নিয়ন্ত্রন, পদোন্নতি প্রদান ও ছুটি মঞ্জুরীসহ শৃঙ্খলা বিধান সংক্রান্ত বিষয় সংবিধানে দুটি অনুচ্ছেদ ১১৫ ও ১১৬ তে পৃথকভাগে বিচার বিভাগের অংশে প্রণীত আছে। তথাপিও উক্ত আইন প্রনয়নের মাধ্যমে অধঃস্তন বিচার বিভাগের বিচারকদের নির্বাহী বিভাগের অধঃস্তন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যা ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘনসহ মাসদার হোসেন মামলার রায়ের সাথেও সাংঘর্ষিক। উক্ত আইন সমূহ সংবিধানের অধীনে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের দুটি বিভাগ (আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ) এর সাথে যথাযথ পরামর্শ ব্যতীত প্রনয়ন করা হয়েছে।
অধঃস্তন আদালতে বিচারক নিয়োগ ও বদলি বিষয়ের বিধিমালা দীর্ঘ কালক্ষেপনের পর নির্বাহী বিভাগ ও মন্ত্রণালয় এমন একটি সময়ে স্থানান্তরিত হয়েছে যখন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য এবং যা সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগের সাথে প্রয়োজনীয় অর্থবহ পরামর্শ ব্যতীত প্রণয়ন করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অধঃস্তন আদালতকে ১৯৯৯ সালের পূর্বের যুগে নির্ধারিত করার সামিল।
তাহলে সর্বোচ্চ আদালত দিবসে আমরা কি বার্তা প্রেরণ করব-এমন প্রশ্ন রেখে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে জনগণ ও সুশীল সমাজকে সচেতন করার কোন বিকল্প নেই। আমাদের ঐক্য মতের মাধ্যমে একত্রিত হয়ে দেশের সাংবিধানিক ভারসাম্য রক্ষা করার প্রচেষ্টাকে একত্রিত করে দৃঢ় ও সংকল্পিতভাবে জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধার করা এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর ভিত্তিতে একটি উপযুক্ত স্বাধীন ও পৃথক বিচার বিভাগের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প নেই।
সূত্র: শীর্ষনিউজ