হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে পেতে সরকারের কাছে দাবি জানানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিসরে যাওয়ার কথা ভাবছেন স্বজনরা। তাদের মতে, আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়গুলোকে শনাক্ত করা জরুরি। এরই আলোকে জাতিসংঘের কার্যকর উইংগুলোয় অভিযোগ জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্বজনরা। মানবাধিকার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, স্বজনরা চাইলেই হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে অভিযোগ করতে পারেন। জাতিসংঘের ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) অনুষ্ঠিত হবে এই জানুয়ারিতে। কেউ যদি মনে করেন, তারা প্রতিকার পাচ্ছেন না, তাহলে ব্যক্তিগতভাবেও লিখে জানাতে পারেন। এতে ইউপিআরে এর প্রভাব পড়বে। এর মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছর ১০ মাসে নিখোঁজ হয়েছেন ৫৪৪ জন। এর মধ্যে ৩৯৫ জনকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালের প্রথম ১০ মাসেই নিখোঁজ হয়েছেন ৫০ জন, যাদের ৩৮ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে ২০১৭ সালে নিখোঁজ হয়েছেন ৯১ জন। তারা তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলছেন, ২০১৭ সালের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল চরম উদ্বেগজনক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও গুপ্ত হত্যার ঘটনার পাশাপাশি এ বছর বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের নিখোঁজ হওয়ার ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। সাবেক রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রকাশক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, রাজনৈতিক দলের নেতা, পৌর মেয়র—কেউই বাদ পড়েননি গুম ও নিখোঁজের এই তালিকা থেকে।
২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে সাজেদুল ইসলাম সুমনকে ‘পোশাকধারীরা’ তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেছেন তার বোন সানজিদা ইসলাম তুলি। তিনি বলেন, ‘যেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়, সেখানে কনস্ট্রাকশনের কাজ চলার কারণে অনেক শ্রমিক ছিল, ভাইয়ের বন্ধু ও কাজিনরা ছিল। তারা সবাই বলেছে, পোশাকধারীরা তুলে নিয়ে গেছে। আমরা পরবর্তী সময়ে র্যাবের অফিসে ও থানায় গিয়েছি। অথচ তারা কেউই বিষয়টি জানেন না বলে জানিয়েছেন। আমরা র্যাবের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাওয়ায় জিডি ও মামলা নেয়নি। এখন চার বছর পর করণীয় কী? আমি নিজে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের কাছে তুলেছি। হিউম্যান রাইটস কমিশনে একসঙ্গে যেতে পারি কিনা, সে বিষয়ে কাজ করছি। তারা বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন।’ হাইকোর্টের রুল পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘২০১৬ সালে রুল পেয়েছি। তুলে নিয়ে যাওয়া ও আটকে রাখা কেন অবৈধ হবে না, রুলে সে বিষয়টি জানতে চেয়েছেন আদালত। সেটি আশার আলো দেখিয়েছিল। আমরা চাই, ওই রুলের আলোকে একটি সুরাহা হোক। কারণ এর পরের ধাপে আমরা আন্তর্জাতিক পরিসরে যাওয়ার কথা ভাবছি। আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়গুলোকে শনাক্ত করা জরুরি।’
সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, ‘চার বছর হয়ে গেছে, আমার ভাইয়ের কোনও তথ্য নেই। আমরা জানতে চাই, তিনি কোথায়? তিনি দোষী হলে সেটিও আমাদের জানানো হোক, তার বিচার হবে প্রচলিত নিয়ম মেনে।’
গুলশান থানা ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক সাইফুর রহমানকে ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তুলে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে পোশাকধারীদের বিরুদ্ধে। আজ পর্যন্ত তার তিনি ফিরে আসেননি। সাইফুর রহমানের বাবা শফিকুর রহমান অন্য নিখোঁজ পরিবারগুলোর মতো এখনও ছেলে ফিরে আসার অপেক্ষা করছেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা নিখোঁজদের স্বজরা সবাই একসঙ্গে যুক্ত হয়েছি। নিখোঁজদের আমরা কোথায় গিয়ে খোঁজ পাবো? আন্তর্জাতিকভাবে যদি চাপ দেওয়া যায়, সবাই সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিলে আমিও যেতে চাই।’ এ ধরনের কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করছেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি ভাবছি আর কী করা যায়? কথাবার্তা চলছে, চূড়ান্ত হয়নি।’
এদিকে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নিখোঁজদের সন্ধান পাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে অভিযোগ দাখিলের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন উইংকে সক্রিয় করা যেতে পারে। তারা নিজেদের মতো করে অনুসন্ধান চালিয়ে অভিযোগকারীদের দেশকে বিষয়টি দেখার জন্য সুপারিশ করে যোগাযোগ করতে পারে।
নিখোঁজদের পরিবারগুলো চাইলে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে অভিযোগ করতে পারে মন্তব্য করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি চাইলে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে আবেদন করতে পারেন। বাংলাদেশ এর সদস্য রাষ্ট্র। হিউম্যান রাইটস কমিটিও আছে, যেখানে নাগরিকরাও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে কমিটিকে আগে আমলে নিতে হবে। আমলে নেওয়ার মতো একটাই জায়গা, সেটি হলো কাউন্সিল। সাধারণত যে প্রক্রিয়ায় তারা গ্রহণ করে, সেখানে আবার ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগের সুযোগ নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইউপিআর জানুয়ারিতে হবে। কেউ যদি মনে করেন, তারা প্রতিকার পাচ্ছেন না বা সংক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাহলে তারা ব্যক্তিগতভাবে লিখতে পারেন। এর মাধ্যমে ইউপিআরে এর প্রভাব পড়বে। তাতে সরকারের ওপরও চাপ সৃষ্টি হবে।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন