কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে রেলওয়েতে আবার ‘কালো বিড়াল’ ভর করেছে। সরকার-সমর্থিত রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদই এমন অভিযোগ তুলেছে। সংগঠনটির অভিযোগ, রেলওয়েতে ৮৬৫ জন খালাসি নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। রেলপথমন্ত্রীর আশপাশে থাকা লোকজনের সমন্বয়ে গঠিত একটি সিন্ডিকেট এই বাণিজ্য করছে।
মন্ত্রী-সাংসদসহ দলীয় নেতাদের সুপারিশের ভিত্তিতে খালাসি পদে লোক নিয়োগ দিতে ‘চাপ’ থাকার কথা নিজ বিভাগের এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বলেছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম)। গত ২৭ ডিসেম্বর ঢাকায় রেল ভবনে ‘অপারেশনাল রিভিউ’ (রেল পরিচালন পর্যালোচনা) নামের ওই বৈঠকে খালাসি পদে নিয়োগ নিয়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করেন তিনি। বৈঠকে অবশ্য রেলপথমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন না।
ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগি পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে নিয়োজিত কর্মী রেলওয়েতে খালাসি নামে পরিচিত। সরকারি বেতন স্কেলের সর্বনিম্ন ধাপে (২০তম গ্রেড) তাঁরা অবস্থান করেন। খালাসিরা সরকারি চাকরিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবেও পরিচিত। এই পদের মূল বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকা। রেলওয়েতে ৮৬৫ জন খালাসি নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে এখন। এই পদে নিয়োগের জন্য ২০১৫ সালে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। মামলার কারণে এত দিন নিয়োগপ্রক্রিয়া স্থগিত ছিল।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত ২৭ ডিসেম্বর সকালে রেল ভবনে শুরু হওয়া ওই বৈঠকে রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের সব বিভাগের প্রধান এবং মহাপরিচালকের কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করেছিলেন রেলের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আমজাদ হোসেন।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা চারজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন রেলের মহাপরিচালককে অবহিত করে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আবদুল হাই খালাসি নিয়োগ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, মন্ত্রী (মুজিবুল হক) তাঁকে (জিএম) নিজেদের লোকজনকে নিয়োগ দিতে বলেছেন। মন্ত্রী, এমপি এবং দলীয় লোকজনের অনেক সুপারিশ আছে। এসব লোককে নিয়োগ দিতে হবে। বৈঠকে জিএম আরও বলেছিলেন, রেলের একজন কর্মচারী কিছুদিন আগে মারা গেছেন। ওই কর্মচারীর পরিবারের সদস্যকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জিএম। কিন্তু মন্ত্রী সেটা মানতে চাইছেন না বলে বৈঠকে জিএম উল্লেখ করেছেন। তবে রেলের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন এ নিয়ে বৈঠকে কোনো মন্তব্য করেননি।
খালাসি নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান। ২৭ ডিসেম্বরের বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অপারেশনাল রিভিউ বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে অনেক কিছু ছিল। নিয়োগ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। খালাসি নিয়ে আলোচনা এবং পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকের অসহায়ত্ব প্রকাশ করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। এই নিয়োগ নিয়ে মন্ত্রীর চাপের কথা মহাব্যবস্থাপক বলেছেন কি না, একই প্রশ্ন আবার করা হলে তিনি বলেন, ‘জি’। এ নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
এর আগে ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল মধ্যরাতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা এবং তৎকালীন রেলমন্ত্রী (প্রয়াত) সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের একান্ত সচিব ওমর ফারুক ৭০ লাখ টাকার বস্তাসহ ঢাকায় বিজিবির সদর দপ্তরে আটক হন। সেদিন তাঁরা গাড়িতে করে তৎকালীন রেলমন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলেন। পথে চালক গাড়িটি বিজিবির গেটের ভেতরে নিয়ে যান। অভিযোগ ওঠে, তাঁদের গাড়িতে পাওয়া টাকার বস্তাটি রেলের নিয়োগ-বাণিজ্যের মাধ্যমে পাওয়া। এ ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। যদিও মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর তৎকালীন রেলমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি রেলের কালো বিড়াল খুঁজে বের করবেন। ইউসুফ আলী মৃধার বিরুদ্ধে রেলের নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে মোট ১৪টি মামলা হয়। পাঁচ বছর কারাগারে থাকার পর তিন মাস আগে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
রেলভবনের বৈঠকে দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. আবদুল হাই স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। চলতি মাসের ৩ জানুয়ারি নিজ দপ্তরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই বৈঠকে উপস্থিত পদস্থ দু-একজন কর্মকর্তা তাঁর বক্তব্যের প্রশংসা করেন। খালাসি পদে অনেক লোক নিয়োগ দেওয়া হবে। চাকরির আবেদনকারীরা গরিব পরিবার থেকে এসেছে। টাকাপয়সা নিয়ে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার পক্ষে নন তিনি। তিনি বলেন, রেলে কালো বিড়াল নিয়ে বদনাম আছে। সেই কালো বিড়াল তাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক গত ৩১ ডিসেম্বর বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘২৭ ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চলের জিএম কী বলেছেন, তা আমি জানি না। অনেক সাংবাদিক, মন্ত্রী, এমপি, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা নিয়োগের জন্য আমার কাছে সুপারিশ করেছেন। আপনিও সুপারিশ করতে পারেন। তবে নীতিমালা মেনে খালাসি নিয়োগ দেওয়া হবে।’
খালাসি নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অনিয়ম নিয়ে রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ গত ৩১ ডিসেম্বর সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে। সংগঠনটির নেতারা বলেন, ঢাকায় রেলপথমন্ত্রীর বাসায় খালাসি নিয়োগের তালিকা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। অথচ এই নিয়োগ পরীক্ষা এবং তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর চট্টগ্রামে হওয়ার কথা। তাঁদের অভিযোগ, খালাসি নিয়োগ চূড়ান্ত করতে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য হচ্ছে।
শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়কারী মোখলেছুর রহমান অভিযোগ করেন, রেলমন্ত্রীর আশপাশের লোকজনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সিন্ডিকেটের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী খালাসি নিয়োগ চূড়ান্ত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, টাকার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া লোকজন কাজ না করে নানা অপর্কম করবে।
সংগ্রাম পরিষদের অভিযোগের বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী বলেন, খালাসি নিয়োগ নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁরা জামায়াত-বিএনপির লোক। নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা ব্যক্তিরা এখন আর রেলের চাকরিতে নেই। দ্রুত নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করতে চান তিনি।
এদিকে ৩১ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করার পরদিনই মোখলেছুর রহমানের ছেলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের নিরীক্ষণ বিভাগের কর্মী (জুনিয়র অডিটর) মোহাম্মদ রবিউল হোসেনের বরাদ্দকৃত বাসা বাতিল করে চিঠি দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তাঁর বাসা চট্টগ্রাম নগরের পলোগ্রাউন্ড এলাকায়। রেলের নিয়োগে অনিয়ম ও বাণিজ্য নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেওয়ায় প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাঁর ছেলের বাসার বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে বলে মনে করেন রেলশ্রমিক নেতা মোখলেছুর রহমান। তিনি বলেন, যা হচ্ছে তা অন্যায় এবং অযৌক্তিক।
সূত্র: প্রথম আলো