সম্ভাব্য প্রার্থীদের আগ্রহের কমতি নেই। চলছে প্রস্তুতিও। সংশয় আইনি জটিলতায় নির্বাচন আটকে যায় কি না, তা নিয়ে। এরই মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার সকালে নির্বাচন কমিশন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র পদে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। ভোটের তারিখ আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি।
তফসিল ঘোষণার পর প্রার্থীরা কিছুটা আশ্বস্ত। তবে এই নির্বাচন ঘিরে সরকারি দলে কিছুটা অস্বস্তি আছে। কারণ, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রংপুরে দলীয় মেয়র প্রার্থীর ভরাডুবির পর এখন রাজধানী ঢাকা নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় নয় বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। আর বিরোধী দল ও সরকারের বাইরের দলগুলোর শঙ্কা—হঠাৎ আইনি মারপ্যাঁচে নির্বাচন পেছাবে না তো? শেষতক নির্বাচন সুষ্ঠু হবে তো? এই দুই শঙ্কা-সংশয় নিয়েই নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
গত ৩০ নভেম্বর মেয়র আনিসুল হকের আকস্মিক মৃত্যুর পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে উপনির্বাচন হচ্ছে। একই সঙ্গে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে নতুন যুক্ত হওয়া ১৮টি করে ৩৬টি সাধারণ ওয়ার্ড এবং ৬টি করে ১২টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডেরও ভোট হবে।
কয়েক দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী ঘোষণা করবে। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ঢাকা উত্তর সিটিতে মেয়র পদে ব্যবসায়ী আতিকুল ইসলামকে অনানুষ্ঠানিক প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তৈরি পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিক মাঠে নেমেছেন। গণসংযোগ করছেন প্রায় প্রতিদিনই।
বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। গত রোববার দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাঁকে ডেকে নির্বাচনের কাজ শুরু করতে বলেন। নির্দেশনা পেয়ে তিনি গতকাল মঙ্গলবার তেজগাঁওয়ে প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় স্থাপনের কাজ শুরু করেছেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টুর বড় ছেলে তাবিথ গতবারও বিএনপি-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী ছিলেন। তিনি প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।
এর বাইরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলন, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন মেয়র পদে প্রার্থী দেবে বলে জানা গেছে। নতুন অনেকে পোস্টার-লিফলেট করে প্রার্থিতার জানান দিয়েছেন।
সম্ভাব্য একাধিক প্রার্থীর সঙ্গে কথা বললে তাঁরা গত নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির কথা স্মরণ করে এবারও একই আশঙ্কার কথা জানান। তফসিল ঘোষণার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাও বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজধানীতে এই নির্বাচন তাঁদের জন্য চ্যালেঞ্জ। অনেকের আশা, রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পর রাজধানীর এই নির্বাচনে নিশ্চয়ই সরকার ও নির্বাচন কমিশন বদনাম কুড়াতে চাইবে না। অবশ্য ঢাকার দুই সিটির গত নির্বাচনে জাল ভোট ও জবরদস্তির ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। বিএনপি দুপুরের আগেই নির্বাচন বর্জন করে। বাম ঘরানার প্রার্থীরা ফল প্রত্যাখ্যান করেন।
গতকাল তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ডিএনসিসিতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সেনা মোতায়েনের দাবি করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমরা অবশ্যই চাইব এখানে যেন সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয়। নির্বাচনের সাত দিন আগে থেকে আমরা সেনাবাহিনী মোতায়েন চাই।’
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, সরকারি দলের বেশির ভাগ নেতা জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজধানীর এই নির্বাচনে আগ্রহী নন। সময়টাকে সুবিধাজনক মনে করছেন না তাঁরা। এর আগে ২০১২ সালে ‘সুবিধাজনক সময়’ মনে হয়নি বলে সরকার আইনি জটিলতায় ফেলে নির্বাচন আটকে দিয়েছিল। এরপর দীর্ঘদিন প্রশাসক দিয়ে চালিয়ে ঢাকাকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করা হয়। ২০১৫ সালে সরকারের এক বছর পূর্তিতে টানা তিন মাস ‘জ্বালাও-পোড়াও’ আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে যখন বিএনপি ঘরে ফেরে, তখনই দুই সিটিতে নির্বাচন হয়। সেটা ছিল সরকারের জন্য সুবিধাজনক সময়। কিন্তু দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা এখন নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মেয়াদ পাঁচ বছরের। ইতিমধ্যে আড়াই বছর মেয়াদ শেষ হয়েছে। বাকি আড়াই বছরের জন্য এক মেয়র ও নতুন ৩৮টি ওয়ার্ডে (সংরক্ষিতসহ) নির্বাচন হবে। তবে নির্বাচন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের ধারণা, নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোর মেয়াদ পাঁচ বছর না হয়ে কেন আড়াই বছর হবে, এই যুক্তিতে সংক্ষুব্ধ কারও মামলা করার আইনি ভিত্তি রয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশন বলেছে, নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডের মেয়াদ হবে বাকি সময়ের জন্য। কিন্তু এ বিষয়ে আইনে স্পষ্টভাবে বলা নেই। ফলে যে কেউ আদালতে গিয়ে মেয়াদ পাঁচ বছর নয় কেন, সে প্রশ্ন তুলতেই পারে। এখন সরকারের দায়িত্ব হবে, নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডে নির্বাচিতদের মেয়াদ কত দিন হবে, তা আইনি সশোধনী এনে স্পষ্ট করা।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। এটা দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।’
আতিকুলকে পরিচিত করতে নির্দেশনা
জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনেই প্রার্থী বাছাইয়ে বিভিন্ন সংস্থার জরিপের সহায়তা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ডিএনসিসি নির্বাচনে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলামকে অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। এই প্রার্থিতা কোনো জরিপের ভিত্তিতে, নাকি ব্যবসায়ী আনিসুল হকের স্থলে আরেকজন ব্যবসায়ীকে মনোনয়ন দেওয়ার চিন্তা থেকে, তা নিশ্চিত নন নেতারা। আতিকুল সফল ব্যবসায়ী হলেও রাজনীতির মাঠে পরিচিত নন। নৌকার জনপ্রিয়তার ওপরই তাঁকে বেশি নির্ভর করতে হবে।
সরকারি দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য একাধিক ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও সংস্কৃতি অঙ্গনের ব্যক্তিরা চেষ্টা-তদবির শুরু করেছিলেন। অনেকে নগরবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টারও লাগান। কিন্তু ডিসেম্বরের শেষ দিকে আতিকুল হক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাঁকে নির্বাচনের জন্য সবুজ সংকেত দেন। পরে গণভবনে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সভায় তিনি আতিকুলকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বলে ইঙ্গিত দেন। এরপর আতিকুল মতবিনিময়সহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামেন। গত শনিবার দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেও শেখ হাসিনা আতিকুল ইসলামকে প্রার্থী উল্লেখ করে তাঁকে পরিচিত করার নির্দেশনা দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, রংপুরে জাতীয় পার্টির কাছে ভরাডুবিতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঢাকায় বিএনপির কাছে আবার হারলে এর ক্ষতি পোষানো কঠিন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী নামালেও তারা এককভাবে নির্বাচন করবে, নাকি ১৪-দলীয় জোটগতভাবে অংশ নেবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়নি। জোটের একাধিক শরিক নেতা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের ভাবনা জেনে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রার্থী মনোনয়নের লক্ষ্যে মনোনয়ন বোর্ডের সভা শিগগিরই হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নষ্ট করে বিএনপি-জামায়াত। তারা নির্বাচন বর্জন করলে নানা প্রশ্ন ওঠে। নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও রংপুরে বর্জন করেনি বলে প্রশ্নও ওঠেনি।’
জামায়াত প্রার্থী দিতে তৎপর
গত নির্বাচনে বিএনপি জোটের বড় শরিক জামায়াতে ইসলামী মেয়র পদে কোনো প্রার্থী দেয়নি। এবার তারা ডিএনসিসিতে মেয়র পদে দলের ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার সভাপতি সেলিম উদ্দীনকে প্রার্থী করেছে। ইতিমধ্যে তিনি দলীয় একাধিক ঘরোয়া কর্মসূচিতে প্রার্থী হিসেবে কথা বলেছেন। গত সোমবার খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে ২০-দলীয় জোটের বৈঠকেও এ নিয়ে কথা ওঠে।
প্রার্থী নিয়ে তৎপর অন্য দলগুলোও
জাতীয় পার্টি রংপুরে জয়ী হলেও ঢাকায় নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের তৎপরতা নেই। পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রার্থী যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে, এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
নতুন রাজনৈতিক জোট যুক্তফ্রন্ট থেকে প্রার্থী দেওয়া হবে কি না, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ওই জোটের শরিক বিকল্পধারা বাংলাদেশের যুগ্ম সম্পাদক মাহী বি চৌধুরী গতবার মেয়র পদে প্রার্থী ছিলেন।
যুক্তফ্রন্টের শরিক দল নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দল থেকে প্রার্থী দেওয়ার কথা ভাবছেন। তবে নির্বাচন হবে কি না এবং হলে কতটা সুষ্ঠু হবে, তা নিয়ে তাঁদের শঙ্কা আছে।
সিপিবি ও গণসংহতি আন্দোলন সূত্র জানায়, সমঝোতার মাধ্যমে বাম সংগঠনগুলো থেকে একক প্রার্থী দেওয়া যায় কি না, সেই আলোচনা চলছে। গত নির্বাচনে গণসংহতি আন্দোলনের আহ্বায়ক জোনায়েদ আবদুর রহিম সাকি (জোনায়েদ সাকি) প্রার্থী হয়েছিলেন। এবারও তিনি প্রার্থী হবেন। ইতিমধ্যে তিনি শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছেন। গণসংহতি আন্দোলনের নিবন্ধন না থাকায় জোনায়েদ সাকিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।
জোনায়েদ সাকি প্রার্থী হওয়ার কথা জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব আইনি সব বাধা দূর করা। ঢাকার মানুষ নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা দেখতে চায়।
গতবার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রার্থী ছিলেন আবদুল্লাহ আল ক্বাফী ওরফে ক্বাফী রতন। এবারও তিনি প্রার্থী হতে চান। আজ সিপিবির সভাপতিমণ্ডলীর সভায় প্রার্থিতা চূড়ান্ত হতে পারে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
ক্বাফী রতন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন। তবে গত নির্বাচনে যে জবরদস্তি হয়েছে, এবার যেন এর পুনরাবৃত্তি না হয়।
চরমোনাইয়ের পীরের দল ইসলামী আন্দোলন গতবারের প্রার্থী শেখ ফজলে বারী মাসউদকে মেয়র প্রার্থী করেছে। তিনি দলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনে অন্য দলগুলোর প্রার্থী থাকলেও মূলত মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই ব্যবসায়ী প্রার্থীর মধ্যে।
ব্যবসায়ী আতিকুল ইসলাম প্রয়াত মেয়রের নাম উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আনিস ভাই যেখানে কাজ অসমাপ্ত রেখে গেছেন, সেখান থেকে আমার কাজ শুরু করতে চাই।’
তাবিথ আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত নির্বাচনে আমরা প্রকাশ্যে ভোট জালিয়াতি, সিল মারার দৃশ্য দেখেছি। বর্তমান কমিশনের অধীনে সেই পুনরাবৃত্তি চাই না। আশা করি, কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগে ঢাকায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করে মানুষের আস্থা জোগাবেন।’
সূত্র: প্রথম আলো