রাজশাহীর পুঠিয়া-দুর্গাপুর আসনের সরকারদলীয় সাংসদ আবদুল ওয়াদুদ (দারা) চাকরি দেওয়ার নামে এলাকার অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও বাসিন্দারা বলছেন, চাকরি আর টাকা—এ দুটোতে বুঁদ হয়ে পড়েছেন সাংসদ।
পুঠিয়া-দুর্গাপুরে গিয়ে জানা গেছে, সাংসদকে টাকা দিয়ে অনেকের চাকরি হয়েছে। আবার চাকরি না হওয়ায় টাকা ফেরত চেয়ে পাচ্ছেন না, এমন অন্তত ১৫ জন প্রথম আলোর কাছে সরাসরি অভিযোগ করেছেন। পাঁচজনকে পাওয়া গেছে, যাঁরা অনেক দেনদরবারের পর আংশিক টাকা ফেরত পেয়েছেন।
গত ৯ বছরে পুঠিয়া ও দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭০০ নিয়োগ হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা জানান, এসব নিয়োগ হয়েছে, তাতে সাংসদ ওয়াদুদের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল। একেকটি নিয়োগের জন্য ৫ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১৭ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অভিযোগ করেছেন। এসব টাকার বেশির ভাগই লেনদেন হয় সাংসদের ভাই শরীফ কাজী, চাচা আলিউজ্জামান ওরফে মন্টু কাজী ও শিলমাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুকুর আলীর মাধ্যমে। সাংসদ সরাসরিও টাকা নিয়েছেন।
অবশ্য তিনজনই এ ধরনের লেনদেনের অভিযোগ অস্বীকার করেন। মন্টু কাজীর দাবি, মানুষ সাংসদকে নিয়ে বানোয়াট কথাবার্তা বলে মজা পায়। এ জন্য এসব কথা বলে।
দুই উপজেলার বিভিন্ন দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আবদুল ওয়াদুদ সাংসদ হওয়ার পর ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত তাঁর নির্বাচনী এলাকা পুঠিয়ায় বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক পদে ২১৭ জন, কলেজের প্রভাষক পদে ১৮৭ জন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী কাম পিয়ন পদে ৩১ জনের নিয়োগ হয়েছে। দুর্গাপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হয়েছে ২০৮ জনের। এ ছাড়া পুলিশের কনস্টেবল পদেও কয়েকজনের নিয়োগ হয়েছে।
অবশ্য সাংসদ ওয়াদুদ ২০১৪ সালে নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা দিয়েছেন, তাতে প্রতিশ্রুতি পালনের ঘরে লিখেছেন, তিনি নির্বাচনী এলাকায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে চার হাজার বেকারের কর্মসংস্থান করেছেন। প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালেও সাংসদ দাবি করেন, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ এলাকার সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সরাসরি তাঁর সুপারিশে ছয় শতাধিক লোকের চাকরি হয়েছে।
দুর্গাপুর উপজেলার আটজন আওয়ামী লীগের নেতা ও জনপ্রতিনিধি সাংসদ ওয়াদুদের চাকরি-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তাঁরা জানান, নয় বছরে দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০৮ জনের নিয়োগ হয়েছে। প্রতিটি নিয়োগের জন্য সাংসদকে ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৮ জন বিএনপির, ১৫ জন জামায়াতে ইসলামীর। ৫ জন জেএমবির সদস্য বলেও তাঁরা দাবি করেন। গত ৭ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগপত্রটি পাঠানো হয়। এতে সই করেন দুর্গাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র তোফাজ্জল হোসেন, রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও কিসমতগনকৈড়ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আফসার আলী মোল্লা, মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান বানেছা বেগম এবং পাঁচজন ইউপি চেয়ারম্যান।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ আবদুল ওয়াদুদ ‘সব সর্বৈব মিথ্যা’ দাবি করে বলেন, তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। চাকরি দিয়ে কারও কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করার প্রয়োজন তাঁর নেই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুনেছি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের (আসাদুজ্জামান) নেতৃত্বে এটি হয়েছে। যারা একসময় আমার কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছে, তারাই এগুলো করছে। তারা আরও সুবিধা চায়, পদ চায়।’
উপজেলার ঝালুকা ইউপির চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা মো. মোজাহার আলী প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদ ওয়াদুদ দুর্গাপুর ডিগ্রি কলেজ ও কানপাড়া জবেদা ডিগ্রি কলেজে এ পর্যন্ত প্রায় এক কোটি টাকার নিয়োগ-বাণিজ্য করেছেন। অথচ তিনি দুই কলেজে দুটি ইটও লাগাননি। মোজাহার নিজেও সাংসদকে আট লাখ টাকা দিয়ে দুজনকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন।
সাংসদ ওয়াদুদ বলেন, ‘কোনো দিনই না। ও তো ঘুষখোর, আপনি আরও ১০ জনকে জিজ্ঞেস করুন।’
দুর্গাপুরের ঝালুকা ডিগ্রি কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ছিলেন মো. এমরান আলী। স্থানীয় আমগাছি বাজারে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, সাংসদ ওয়াদুদ টাকা নিয়ে কলেজে অনেককে চাকরি দিয়েছেন। তিনিও কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগে ছেলে জারমান আলীর চাকরির চেষ্টা করেন। এ জন্য সাংসদের চাহিদামতো আট লাখ টাকা জোগাড়ও করেন। তিনি বলেন, ‘ছেলের চাকরির জন্য পুকুর বিক্রি করেছিলাম। কিন্তু এমপি টাকা লেয়নি। বেশি টাকায় আরেকজনকে লিয়ে লিয়েছে।’
পাঁচ বছরেই জমি, ফ্ল্যাট ও গাড়ির মালিক
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সাংসদ হওয়ার আগে আবদুল ওয়াদুদের জমি-জিরাত, ফ্ল্যাট ছিল না। ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় আবদুল ওয়াদুদ তথ্য দেন, নিজের, স্ত্রীর বা তাঁর ওপর নির্ভরশীল কারও নামে কৃষি-অকৃষি জমি নেই। সাংসদ হওয়ার পর পাঁচ বছরে সেই অবস্থা পাল্টে যায়। ২০১৪ সালের হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেন, স্ত্রী ও তাঁর কৃষি-অকৃষি জমি আছে। নিজের নামের কৃষিজমির দাম ৬২ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৫ টাকা, স্ত্রীর কৃষিজমির দাম ৪০ লাখ টাকা। আর তিনি যে অকৃষিজমির মালিক হয়েছেন, তার বাজারদর ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার ৮২১ টাকা।
দুটি নির্বাচনী হলফনামা পরখ করে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সাংসদ ওয়াদুদ দুটি জিপগাড়ির মালিক হয়েছেন। একটির দাম দেখানো হয়েছে সাড়ে ৬৫ লাখ টাকা, আরেকটি সাড়ে ২৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া নিজের ও স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাটও আছে, যার দাম দেখানো হয়েছে সাড়ে ১২ লাখ করে ২৫ লাখ টাকা। যদিও ২০০৮ সালের হলফনামায় শুধু স্ত্রীর নামে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দামের একটি ফ্ল্যাটের উল্লেখ ছিল। তবে ফ্ল্যাটগুলো কোথায়, তা তিনি জানাননি।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, প্রথম পাঁচ বছরেই সাংসদের এত আর্থিক উন্নতি হয়েছে। এই পাঁচ বছরে আরও কত কী হয়েছে, তা জানতে হয়তো আরেকটি হলফনামার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
আর্থিক উন্নতির কথা অস্বীকার করেন না সাংসদ। তিনি বলেন, ‘১৯৯৫ সাল থেকে আমি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী ব্যবসায়ী। ১৯৯৫ সালে ১৯৮টি মেশিন দিয়ে যাত্রা শুরু করি। এখন সাড়ে চার হাজার মেশিন আমার গ্রুপের। প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা লভ্যাংশ নিচ্ছি, ব্যবসার কারণেই এই উন্নতি।’
পুঠিয়ার ফজলের গল্প
আবুল ফজল প্রামাণিক পুঠিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক ও রাজশাহী জেলা পরিষদের সদস্য। তিনি ছোট ভাই মঞ্জুরুল ইসলামকে পুঠিয়া পিএন উচ্চবিদ্যালয়ে বিএসসি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য সাংসদ ওয়াদুদের শরণাপন্ন হন। ২০০৯ সালের মে মাসে দুই লাখ টাকাও দেন। মঞ্জুরুল নিয়োগ পাননি। বেশি টাকায় নিয়োগ হয় অন্যজনের। আবুল ফজল দেখা করলে সাংসদ কথা দেন মঞ্জুরুলকে ঝলমলিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হবে। সেখানেও হয়নি। এবার সাংসদ আশ্বাস দেন বানেশ্বর ইসলামিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার। সেখানেও মঞ্জুরুলের নিয়োগ হয়নি। এভাবে একের পর এক বাদ পড়ার পর আবুল ফজল সাংসদের কাছে টাকা ফেরত চান। জবাবে সাংসদ বলেন, রাজনীতি করতে টাকা লাগে, ওই টাকা খরচ হয়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহী গেলে সবার সামনেই পুরো ঘটনা বলেন আবুল ফজল। এ সময় সাংসদ ওয়াদুদও ছিলেন। বিব্রতকর অবস্থায় এইচ টি ইমাম বিষয়টি এড়িয়ে যান।
আবুল ফজল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংসদের কাছ থেকে টাকা তুলতে না পেরে আমি নিজের পকেট থেকে ছোট ভাইকে এক লাখ টাকা দিয়েছি। অথচ সেদিন সাংসদ টাকা গুনে নিজের কোটের পকেটে ঢোকান।’
এ সম্পর্কে সাংসদ ওয়াদুদের বক্তব্য, ‘ও একটা নোংরা মানুষ। এই ফজলকে সবাই চিট বলে চেনে। তার এসব কথা কোনোভাবেই সত্য না।’
দুর্গাপুরে আজাদের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ও মেয়ের চাকরি
অভিযোগ আছে, ১১ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে ঝালুকা গাউসুল আজম দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে চাকরি হয়েছে উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের বাসিন্দা রোজিনা খাতুনের। তাঁর বাবা আবুল কালাম আজাদ দেলুয়াবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, ভাই হাবিবুল বাশার দুর্গাপুর পৌরসভা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। তারপরও এত টাকা দিয়ে রোজিনার চাকরি হওয়াটা এলাকায় আলোচিত বিষয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্রীপুরের একজন বাসিন্দা জানান, রোজিনার বাবা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু সাংসদ ওয়াদুদের একজন ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ সালে ওয়াদুদ সাংসদ হওয়ার পর তাঁর আমন্ত্রণে পুঠিয়ার বিড়ালদহে একটি স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার। ওই অনুষ্ঠানে দলবল নিয়ে যেতে আবুল কালাম আজাদকে ফোন করেন সাংসদ। পথে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ডান পা ভেঙে যায় আজাদের। দেশে ও বিদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ লাখ টাকা খরচ হয়েছে তাঁর চিকিৎসায়। এখন তিনি পঙ্গু।
খুব আক্ষেপ করে আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওনার (সাংসদ) জন্য আমি আমার পা হারিয়েছি। মনে অনেক দুঃখ, এটা আমার দুর্ভাগ্য। মেয়ের চাকরির জন্য ৫ লাখ দিয়েছি, নাকি ১১ লাখ দিয়েছি, এ নিয়ে আর নাড়াচাড়া করতে চাচ্ছি না।’
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সাংসদ ওয়াদুদ বলেন, ‘বাচ্চুর (আবুল কালাম আজাদ) কথা বলছেন? ওর মেয়েকে কেউ চাকরি দেবে না। আমি অনুরোধ করে চাকরি দিয়েছি। বাচ্চুকে নেতা বানিয়েছি, তার ছেলেকে নেতা বানিয়েছি। ওকে কত সহযোগিতা করেছি। ইশ্, ওকে বলুন, এমপির সামনে এসব কথা বলেন তো!’
চাকরি হয়নি, টাকাও ফেরত পাননি
পুঠিয়া উপজেলা যুবলীগের ক্রীড়া সম্পাদক আবদুর রহমান নিজের এবং আরও তিনজনের চাকরির জন্য তদবির করেন। ওই তিনজনের চাকরি হয়েছে, নিজেরটি ছাড়া। এর মধ্যে পাঁচ লাখ টাকায় বানেশ্বর ইউনিয়নের পলাশবাড়ি গ্রামের হাসান পুলিশের কনস্টেবল পদে, সাড়ে চার লাখ টাকায় মেহেদি হাসান প্রাইমারি স্কুলের নৈশপ্রহরী পদে ও ছয় লাখ টাকায় কনস্টেবল পদে নীলা খাতুন চাকরি পান। নীলা খাতুন ৫০ হাজার টাকা কম দেওয়ায় চাকরি থেকে বাদ পড়বেন, এমন কথা এলাকায় প্রচার পায়। ওই অবস্থায় বানেশ্বর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সেক্রেটারির হাত দিয়ে ওই টাকা দেওয়া হয়।
এসব তথ্য জানিয়ে যুবলীগের নেতা আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি অফিস সহকারী পদে চাকরির জন্য সাংসদকে সাড়ে চার লাখ টাকা দিই। এই টাকা লেনদেন হয় সাংসদের চাচা আলিউজ্জামান ওরফে মন্টুর মাধ্যমে। অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর তিন লাখ টাকা ফেরত দিয়েছেন। এখনো দেড় লাখ টাকা বাকি আছে।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ ওয়াদুদ দাবি করেন, তিনি আবদুর রহমানকে চেনেন না।
উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক শরীফুল ইসলাম পচামাড়িয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে চাকরির জন্য কয়েক বছর চেষ্টা-তদবির করেন। তিনি পাঁচ লাখ টাকাও দিতে রাজি হন। কিন্তু তাঁকে চাকরি না দিয়ে ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মাসুদুর রহমানের স্ত্রী আসমা বেগমকে সাত লাখ টাকায় চাকরি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন শরীফুল।
শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের সুখপাড়া গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেন পচামাড়িয়া ডিগ্রি কলেজে প্রভাষক পদে চাকরির জন্য সাংসদকে ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়েছেন। টাকা লেনদেন হয় শিলমাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুকুর আলীর মাধ্যমে।
শুকুর আলী টাকা লেনদেনের কথা অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব কথা বিএনপির লোকজন বলে।’
বানেশ্বর ইউনিয়নের পলাশবাড়ি গ্রামের মিজানুর রহমান পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরির জন্য চার লাখ টাকা ও শফিকুল ইসলাম দুই লাখ টাকা দিয়েছিলেন সাংসদকে। এই টাকা নেন চাচা মন্টু কাজী। পরে শফিকুলের দুই লাখ টাকা ফেরত দিয়েছেন মন্টু কাজী। বিদ্যুতের তিনটি খুঁটির জন্য শরীফ কাজীকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন পলাশবাড়ির মো. জুয়েল। খুঁটিও পাননি, টাকাও ফেরত পাননি।
মো. জাফর ইকবাল পুঠিয়া আইডিয়াল ডিগ্রি কলেজের অর্থনীতির প্রভাষক। কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেতে তিনি একজন প্রার্থী ছিলেন। জাফর ইকবাল একসময় উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। তিনি রাজশাহী জেলা পরিষদের সদস্য ও বেলপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মাসুদসহ আরও কয়েকজনের উপস্থিতিতে ২০১৬ সালে সাংসদকে পাঁচ লাখ টাকা দেন। এ বছরের ২১ এপ্রিল উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পান আবদুল মান্নান নামের একজন।
জাফর ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুনেছি মান্নানের কাছ থেকে ১৭ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। এই নিয়োগের কয়েক দিন পর আমার ৫ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছেন এমপি।’
বেলপুকুর ইউপির চেয়ারম্যান ও পুঠিয়া থানা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এমপি একটি পদে চাকরি দিতে অনেক লোকের কাছ থেকে টাকা নেন। যে সবচেয়ে বেশি দেয়, সে বিএনপি হোক, জামায়াত হোক আর জঙ্গি হোক—তাকেই চাকরি দেন।’
রাজশাহী জেলা যুবলীগের সহসভাপতি ওবায়দুর রহমানের বাড়ি পুঠিয়া উপজেলার জামিরা গ্রামে। ওবায়দুরের স্ত্রী শরীফা রাহাতিল আশিকিনা বানেশ্বর কলেজের প্রভাষক পদে পরীক্ষা দিয়ে প্রথম হয়েছিলেন। কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি সাংসদ আবদুল ওয়াদুদ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা একজনকে নিয়োগ দিতে টাকা নিয়েছিলেন। ওই প্রার্থী পরীক্ষায় ফেল করেন। নিয়োগ বোর্ড তাঁকে নিয়োগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে সাংসদ বাধ্য হয়ে শরীফা রাহাতিলকে নিয়োগ দিতে বলেন। তারপরও সাংসদকে আট লাখ টাকা দিতে হয়েছে।
ওবায়দুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিজের টাকা খরচ করে আবদুল ওয়াদুদের নির্বাচন করেছি। দলে আমার অবস্থান আছে। তারপরও স্ত্রীর চাকরির জন্য আমার ভাই সালমান খুরশীদকে দিয়ে এমপির জন্য ছয় লাখ টাকা পাঠাই। তাতেও হয়নি, আরও দুই লাখ টাকা দিতে হয়েছে। এমপি নিজ হাতে এই টাকা নিয়েছেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ ওয়াদুদ বলেন, ‘ছি! ছি! এ ধরনের কথা আপনি শুনেছেন, আমাকেও শুনতে হচ্ছে। এসব সর্বৈব মিথ্যা। ওকে তো জুতা মারা উচিত।’ সাংসদ দাবি করেন, তিনি এলাকায় প্রায় শতকোটি টাকার খাল খনন ও সংস্কার করেছেন। কৃষির জন্য ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বাঁধ নির্মাণ করছেন। রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন করে এলাকাকে গুছিয়ে ফেলেছেন। এখন একটি চক্র তাঁর বিরুদ্ধে লেগেছে।
দলীয় সাংসদের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে চাকরি দেওয়া না-দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বিরক্তি প্রকাশ করেন। তিনি প্রথম আলোকেবলেন, ‘টাকা দিয়ে চাকরি না পাওয়া, টাকা নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ অনেকেই করেন। এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের ভেতরে ক্ষোভ আছে। বিষয়টি দলের ঊর্ধ্বতনদের জানানো হয়েছে।
প্রথম আলো এ বিষয়ে এর আগে আরও চারটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেমন গত ডিসেম্বরে ‘ভেজাল সুলতান’, ‘সাংসদ আমজাদের ব্যাপক উন্নতি’, ‘বগুড়ায় সব অপরাধের মূলে চাঁদাবাজি’, ‘বগুড়ায় তুফানের “বাবা” শামসুদ্দিন’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
সূত্র: প্রথম আলো