এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এবার পাওয়া গেল বাসভর্তি পরীক্ষার্থীদের কাছে, পরীক্ষার ঘণ্টাখানেক আগে। সেই প্রশ্নে পরীক্ষাও হলো। চট্টগ্রাম শহরের বাংলাদেশ মহিলা সমিতি (বাওয়া) বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ কেন্দ্রের কাছে গতকাল মঙ্গলবার ফাঁস হওয়া পদার্থবিজ্ঞানের ওই প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ২৪ জন পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার এবং ৯ জনকে আটক করা হয়েছে।
১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষার আবশ্যিক সাতটি বিষয়েরই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। গতকাল শুরু হয়েছে বিভাগভিত্তিক বিষয়ের পরীক্ষা। এর মধ্যে গতকাল বিজ্ঞান বিভাগের পদার্থের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গতকাল সারা দেশে মোট ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আগের বছরগুলোতে দু-একটি বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁস হলেও এবার আগাম ঘোষণা দিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। মূলত ২০১২ সালের পর থেকে পাবলিক পরীক্ষা হলেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠছে। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা, এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হচ্ছে। এখন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে সরকারের অবস্থা অনেকটা লেজেগোবরে। একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হচ্ছে না।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের বাস্তবতা এত দিন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকার পাশ কাটিয়ে গেছে। ফলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের পুরো বিষয়টি এখন সরকারের নাগালের বাইরে। এখন যেভাবে তৎপরতা দেখানো হচ্ছে, আগে এসব ব্যবস্থা নিলে হয়তো এমন ঘটনা ঘটত না।
আগে শুধু এসএসসি ও এইচএসসি এবং সমমানের বোর্ডের পরীক্ষা হতো। কিন্তু গত ৯ বছরে পঞ্চম শ্রেণিতে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী এবং অষ্টম শ্রেণিতে জেএসসি, জেডিসি নামে নতুন পাবলিক পরীক্ষা চালু করা হয়েছে। আবার একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে শুধু ফলাফলের ওপর নির্ভর করা হচ্ছে। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিসহ শিক্ষায় নতুন কিছু পদ্ধতিও চালু করা হয়েছে। পাঠ্যবইয়েও এসেছে নানা পরিবর্তন। কিন্তু সুপরিকল্পনার ঘাটতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে শিক্ষাব্যবস্থায়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরাও মনে করছেন, চলতি এসএসসি পরীক্ষায় হয়তো প্রশ্নপত্র ফাঁস আর ঠেকানো যাবে না। তবে এটাকে এখন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারা দেশে ব্যাপক ধরপাকড় চলতে থাকবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান প্রক্রিয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁস একেবারে বন্ধ করা কঠিন হবে। তাই আগামী দিনে পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে বিভিন্ন বিকল্প চিন্তা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
যেভাবে ধরা পড়ল বাসভর্তি ফাঁস প্রশ্ন
পরীক্ষা শুরুর দেড় ঘণ্টা আগে সকাল সাড়ে আটটায় ৫৪ জন এসএসসি পরীক্ষার্থীকে বহনকারী বাসটি থামে চট্টগ্রাম শহরের বাংলাদেশ মহিলা সমিতি (বাওয়া) বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ কেন্দ্রের কাছে। পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে ১০০ গজ দূরে। তখন বাসের ভেতরে পরীক্ষার্থীদের কেউ কেউ মোবাইল বা ট্যাব নিয়ে ব্যস্ত। তাদের ঘিরে আছে আরও কিছু পরীক্ষার্থী। তারা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আলোচনা করছে। কিন্তু আকস্মিকভাবে বাসের ভেতর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঢুকতেই এই চিত্রের ছন্দপতন ঘটে। পরীক্ষার্থীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের কাছে থাকা মোবাইল ফোন, ট্যাব ও খাতা কেড়ে নেন ম্যাজিস্ট্রেট। যাচাই করে দেখেন, মোবাইল ফোন ও ট্যাবে রয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিক অংশের (এমসিকিউ) প্রশ্ন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মোরাদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, চিটাগাং আইডিয়াল স্কুলের পটিয়া শাখার পরীক্ষার্থীদের বহনকারী বাসে ফাঁস করা প্রশ্ন নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া হয়—এ রকম একটি সংবাদ তাঁদের কাছে ছিল। গতকাল বাসটি যখন থামে তখন কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সকাল ৯টায় তাঁরা বাসে ঢোকেন। এ সময় পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে মুঠোফোন ও ট্যাব জব্দ করেন। তাদের মুঠোফোন ও ট্যাবে প্রশ্নপত্রের সঙ্গে পরীক্ষার মূল প্রশ্নপত্র পুরোপুরি মিলে যায়।
ওই বাসে মোট ৫৪ জন পরীক্ষার্থী ছিল। তারা চিটাগাং আইডিয়াল স্কুলের পটিয়া শাখার শিক্ষার্থী। এর মধ্যে বিজ্ঞানের ২৪ জন শিক্ষার্থীর সবাইকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯ জনকে আটক করা হয়। ওই বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকাকেও আটক করা হয়। বাসে থাকা বাকি ৩০ জন পরীক্ষার্থী অন্য শাখার শিক্ষার্থী হওয়ায় লিখিত বক্তব্য নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র নিয়ে বাসের ভেতর পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতি নেওয়ার খবর তাঁরা কয়েক দিন আগেই পান। আটক ৯ পরীক্ষার্থী এবং তাদের এক শিক্ষিকার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে ওই সব পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া হয়। বেলা একটায় পরীক্ষা শেষে তাদের একটি কক্ষে রাখা হয়। সেখানে জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদ করে। দুই পরীক্ষার্থী জানায়, হোয়াটসঅ্যাপে ‘আহমেদ সায়েম’ নামের একটি গ্রুপ থেকে তারা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন সংগ্রহ করে। সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে তারা এমসিকিউ অংশের প্রশ্ন পায়।
প্রশ্ন ফাঁসের আরও ঘটনা ও গ্রেপ্তার
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গতকাল বিভিন্ন এলাকায় আরও ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিনিধি ও সংবাদাতাদের পাঠানো খবর:
র্যাব-২ গত রোববার দিবাগত রাত আড়াইটায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ের তালতলা বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর নাম সাব্বির হোসেন। বাড়ি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে। তিনি ধামরাই সরকারি কলেজে পড়েন। র্যাব জানায়, তিনি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ‘মিসাইল গ্রুপ’-এর মাধ্যমে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে পরীক্ষার্থীদের কাছে বিকাশের মাধ্যমে টাকা নিয়ে প্রশ্নপত্র পাঠাতেন।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার হেঁয়াকো বনানী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে থেকে পরীক্ষা শুরুর প্রায় ৪০ মিনিট আগে পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নসহ সাত শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হাসনাত মো. শহীদুল হক বলেছেন, ওই সব শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোনে থাকা প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষার মূল প্রশ্ন মিলে গেছে।
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে চারজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার এবং বহিরাগত একজনকে আটক করা হয়। ইউএনও শরিফ আহম্মেদ বলেন, ভূঞাপুর পাইলট সরকারি বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে কয়েকজন শিক্ষার্থী কেন্দ্রে প্রবেশ না করে মোবাইল ফোনে প্রশ্ন দেখছিল। এ ঘটনায় চারজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া বহিরাগত এক কলেজ শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে।
পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলায় গতকাল পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর মুঠোফোনে পাওয়ায় রিপন চক্রবর্তী (৩০) নামের এক যুবককে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
নীলফামারীর সৈয়দপুরে সকালে ক্যান্ট বোর্ড হাইস্কুল পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রবেশের সময় এক পরীক্ষার্থীকে মোবাইলে প্রশ্নপত্রসহ আটক করেন সৈয়দপুরের ইউএনও মো. বজলুর রশীদ। সে লক্ষ্মণপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে মুঠোফোনের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে জাকির হোসেন (২৯) নামের এক যুবককে চার মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরীক্ষা শুরুর প্রায় ৩০ মিনিট আগে মির্জাপুর কলেজ পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরের মাঠে ওই ব্যক্তি মুঠোফোন থেকে পরীক্ষার্থীদের উত্তরসহ প্রশ্ন সরবরাহ করছিলেন। গ্রেপ্তারকৃত জাকির হোসেন ইমো অ্যাপের মাধ্যমে উত্তরসহ প্রশ্নপত্র পেয়েছিলেন, যা পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে। এ ছাড়া আরেকটি কেন্দ্রের কাছে মুঠোফোন ব্যবহার করায় তিনজনকে আটক করা হয়।
ময়মনসিংহের ভালুকায় পরীক্ষা শুরু হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে হবিরবাড়ি সোনার বাংলা উচ্চবিদ্যালয় এবং ভালুকা পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের কেন্দ্রের কাছ থেকে মোবাইল ফোনে পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নোত্তর পাওয়ায় ৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে দিনাজপুরের বিরামপুর, বিরল ও বোচাগঞ্জে ৭ পরীক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশে সোপর্দ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
কেন্দ্রের আশপাশে মোবাইল ফোন চলছে
প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে গত সোমবার কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে কারও কাছে মোবাইল ফোন পাওয়া গেলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু গতকাল কেন্দ্রের সামনে এ বিষয়ে শিথিলতা দেখা গেছে। গতকাল মগবাজার এলাকার নজরুল শিক্ষালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, একেবারে রাস্তাঘেঁষা এই কেন্দ্রের কাছে অন্যান্য মানুষের হাতে মোবাইল ফোন। একাধিক অভিভাবক বলেন, ঢাকায় এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কঠিন।
সূত্র: প্রথম আলো