একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বেড়েছে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা। সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতির বিষয় জানতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন তারা। কখনো একান্তে, কখনো বা দলবেঁধে। বাংলাদেশ সফরে এসেও অনেকে ইসির সঙ্গে বৈঠকে বসা ভুলছেন না। সিইসি কে এম নূরুল হুদা তাদের কাছে তুলে ধরছেন সংসদ নির্বাচনে প্রস্তুতির সার্বিক বিষয়াদি। ঢাকায় নিয়োজিত বিদেশি কূটনীতিক কিংবা সফরে আসা বিদেশি বিভিন্ন দূত ও পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসির বৈঠকগুলোতে আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি।
বিদেশি কূটনীতিকরা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসিকে সহযোগিতার কথা দিচ্ছেন। আর জানতে চাচ্ছেন, বিএনপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত এবং একটি গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশন কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য বিরোধী দল যে দাবি জানিয়ে আসছে সে বিষয়ও ইসির কাছ থেকে বিস্তারিত জানতে চাইছেন কূটনীতিকরা। এ ছাড়া নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নির্বাচনী খরচের সার্বিক তথ্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন অনেকেই। জানা গেছে, বিদেশি কূটনীতিকরা নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে সরকারি এবং সংসদের ভিতরে-বাইরের বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। বিএনপি নেতারা বলছেন, কূটনীতিকরা সবার অংশগ্রহণে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং ‘স্বাধীন ও বিশ্বস্ত’ নির্বাচন কমিশন দেখতে চান। সরকারি দলের নেতারা বলছেন, নির্বাচনে বিদেশিদের নাক গলানোর কিছু নেই। তবে সিইসির সঙ্গে কূটনীতিকরা সৌজন্য সাক্ষাৎ করতেই পারেন।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে ভালো নির্বাচন হোক এ জন্য কূটনীতিকরা নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তারা চান সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন। এদিকে নির্বাচনে বিদেশিদের ভূমিকার বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, আমরা আন্তর্জাতিকভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ জন্য অন্যরা দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করতে পারে। আর সুষ্ঠু নির্বাচন সবার জন্য ভালো। অশান্ত নির্বাচন হলে অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে পড়বে। তিনি বলেন, বিগত নির্বাচন কমিশন অনেকটা বিপর্যয়ে ফেলেছে। এই নির্বাচন কমিশন এখনো আস্থা অর্জন করতে পারেনি। তাদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
গত বছর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর সিইসির সঙ্গে বৈঠক করেছে মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ভারতের হাইকমিশনার, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত, নরওয়ে ও সুইডেনের রাষ্ট্রদূত, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দলসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। সর্বশেষ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সিইসির সঙ্গে বৈঠক করেন জিম ল্যামবার্ডের নেতৃত্বে ঢাকা সফররত আট সদস্যের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দল। এ সময় তারা দুর্নীতির দায়ে কারাবাসের সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কিনা সে বিষয়েও আলোচনা করেন। তারা বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনী খরচের সার্বিক তথ্য সম্পর্কেও সিইসির কাছে জানতে চান। পরে জিম ল্যামবার্ড সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় ইইউ। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, ইইউ চায় যেন সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোটার তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। আর সব রাজনৈতিক দল যেন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে।
গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিইসি নূরুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন গঠনের পরে মার্চ মাসে সিইসির সঙ্গে বৈঠক করেন নরওয়ে এবং সুইডেনের রাষ্ট্রদূত। তাদের আলোচনায় ঘুরেফিরে আসে আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার কথা। গত বছরের মে মাসে সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। ওই সাক্ষাতের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেছিলেন, ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি কেমন, কবে নাগাদ নির্বাচন হতে পারে, ইতিমধ্যে হয়ে যাওয়া নির্বাচনগুলো নিয়ে কথা হয়েছে। আমরা যেসব নির্বাচন করেছি এগুলো ভালো হয়েছে বলে জানান হাইকমিশনার। মে মাসে সিইসির সঙ্গে আরও সাক্ষাৎ করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট। এ সময় বৈঠকে বড় দলের অংশগ্রহণ ছাড়া অর্থাৎ আর ‘বর্জনের নির্বাচন’ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সবাইকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের ওপর গুরুত্ব দেন মার্শা বার্নিকাট।
জানা গেছে, এ সময় আগামী নির্বাচনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা ছাড়াও বিগত নির্বাচনে অভিজ্ঞতা, নতুন চ্যালেঞ্জ, তাদের প্রত্যাশা ও সহযোগিতার কথা তুলে ধরেছে মার্কিন রাষ্ট্রদূত। পরে বার্নিকাট সাংবাদিকদের বলেন, আগামী নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে সব দলের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এটা শুধু ভোটের দিন নয়। সবাই যেন ভোটে প্রার্থী দিতে পারে এবং তারা সুচারুভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারে সেই দিকটি দেখতে হবে। বাংলাদেশের অনেক ভালো নির্বাচনের ইতিহাস রয়েছে। আমরাও চাই ভোটের দিন প্রতিটি নাগরিক যেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারে। তাদের প্রতিটি ভোট গণনা হবে এটাও যেন নিশ্চিত হয়। গত নভেম্বরে সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেনসিয়ে স্টিয়েরিংয়ের নেতৃত্বে দুই সদস্যের প্রতিনিধি দল। বৈঠকে সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি ও অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। পরে সিইসি কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। সিইসি কে এম নূরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন, ইইউর পূর্ণ আস্থা রয়েছে আমাদের ওপর। আমরাও আশ্বস্ত করেছি, ভোটের সুস্থ পরিবেশ বজায় থাকবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমরাও বদ্ধপরিকর। ইইউ প্রতিনিধি দল ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের বিষয়টিও তোলেন আলোচনায়। সিইসি বলেন, একাদশ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা সম্ভব হবে না বলে তাদের জানানো হয়েছে।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন