একটি ট্রাস্টের ২ কোটি টাকা অ্যাকাউন্ট পরিবর্তনের জন্য দু‘বারের সফল সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন ৫ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে। যা দেশের রাজনীতিকেও উলোট-পালট করে দিয়েছে। শুধু দেশ নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। ঠিক এ রায় ঘোষণার আগে ফাঁস হয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান- জনতা ব্যাংকের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ কেলেঙ্কারির তথ্য। আওয়ামী লীগের এক ব্যক্তির মালিকানাধীন ২২ প্রতিষ্ঠানে ৬ বছরের ব্যবধানে দেয়া হয়েছে এ ঋণ ও ঋণসুবিধা। যার মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এতে ব্যাংকটিই কার্যত এখন অচল। নতুন করে ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই। ঋণ পাওয়া সৌভাগ্যবান এক ব্যক্তির খেয়ালখুশির ওপরই এখন নির্ভর করছে ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ। কারণ, তিনি ঋণের টাকা ফেরত না দিলে দেউলিয়া হতে পারে ব্যাংকটি নয়তো সরকার থেকে ঋণ নিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার লড়াই করতে হবে। তাইতো মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকারের কাছে আড়াই হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারাকাতের ছত্রছায়ায় এ লুটপাট হয়। ব্যাংকটির তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুর রহমানও এ অপকর্মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। মূলত বারাকাত-আমিনুর যৌথভাবেই ব্যাংকটিতে এ লুটপাট চালিয়েছেন।
আবুল বারাকাত ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ বছর জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। আমিনুরও সেই পর্যন্ত ব্যাংকটিতে এমডি পদে ছিলেন। এ সময়েই হয়েছে জনতা ব্যাংকের অর্থ হরিলুটের এমন কাণ্ড। কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছর ধরে ব্যাংকটিতে হরিলুট চললেও এত দিন তা ধামাচাপাই ছিল। বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখতে তৎপর ছিলেন এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের অবৈধ সুবিধাভোগী কিছু অসাধু কর্মকর্তা। কিন্তু ব্যাংকটির পরিবর্তিত পরিচালনা পর্ষদের চাপাচাপিতে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এ সব তথ্য তুলে ধরতে বাধ্য হয় এর ব্যবস্থাপনা বিভাগ। ঋণের নামে ব্যাংকের অর্থ হরিলুটের ভয়ংকর এ তথ্য উঠে আসায় নড়েচড়ে বসেছেন লুটপাটে সংশ্লিষ্ট অনেক রাঘব বোয়াল। যদিও চক্রের মূল হোতা বারাকাত অর্থ লুটকারী ওই আওয়ামী লীগ নেতার পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন। যা শুনে আশ্চর্য হয়েছেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রীও। বলেছেন, সংশ্লিষ্ট ‘দুষ্টচক্রের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও। তবে এক ব্যক্তিকে একটি ব্যাংক থেকে বিপুল অংকের এ ঋণ দেয়ার তথ্য ফাঁস হওয়ায় সরকারের পুরো ব্যাংকিংখাতই নতুন করে বিতর্কে পড়েছে। দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ব্যাংকটিতে আমানতকারীরা। কিন্তু দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে এখনো কোনো মামলা না হওয়ায় হতাশা আরো বেড়েছে। এই টাকা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব বলেও মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
একক ব্যক্তির ঋণে বৃহত্তম কেলেঙ্কারি
জনতা ব্যাংকের মোট মূলধন ২ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। নিয়ম অনুযায়ী একজন গ্রাহককে মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেয়ার সুযোগ আছে। অর্থাৎ এক গ্রাহক জনতা ব্যাংক থেকে কোনও অবস্থায়ই ৭৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পেতে পারেন না। অথচ এক গ্রাহককেই মাত্র ৬ বছরে দিয়েছে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা। নিয়মনীতি না মেনে এভাবে ঋণ দেয়ায় বিপদে পড়েছে ব্যাংকটি। গ্রাহকও এখন ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। ব্যাংক দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের, সরকারের নিয়োগ দেয়া সেই পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আবুল বারাকাতই এই বিপজ্জনক হরিলুটের কাজটি করেছেন। যার সঙ্গে যুক্ত ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুর রহমানও। হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর এটিকেই পারস্পরিক যোগসাজশে সাধারণ মানুষের আমানত নিয়ে ভয়ংকর কারসাজির আরেকটি বড় উদাহরণ বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, এটি একক ঋণের বৃহত্তম কেলেঙ্কারি। মূলত এটি সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক এবং বেসিক ব্যাংক কেলেংকারিকেও ছাড়িয়ে গেছে।
জানা গেছে, বারাকাত-আমিনুর ছাড়াও ওই সময় ব্যাংকটির পর্ষদ সদস্য ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বলরাম পোদ্দার, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক নাগিবুল ইসলাম ওরফে দীপু, টাঙ্গাইলের কালিহাতী আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী যুবলীগ নেতা আবু নাসের প্রমুখ। বর্তমান এমডি আবদুস ছালাম আজাদও এই ঋণ কেলেঙ্কারির সাথে যুক্ত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে জনতা ব্যাংকের ওই পর্ষদের উৎসাহ-ই ছিল বেশি। পর্ষদের সিদ্ধান্তে বারবার ঋণ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঋণ দেয়া হয় খেয়ালখুশি মতো। ব্যাংকের উদার আনুকূল্য পাওয়া এই গ্রাহক হচ্ছেন এননটেক্স গ্রুপের মালিক মো. ইউনুস (বাদল)। তিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। তারই স্বার্থসংশ্লিষ্ট ২২ প্রতিষ্ঠানের নামে সব ঋণ নেয়া হয়। ব্যাংকে ঋনের টাকায়ই এ প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক গড়ে উঠে এবং ইউনুস রাতারাতি বৃহৎ শিল্পপতি বনে যান। এক সময়ের বাসশ্রমিক তিনি। পরে আওয়ামী শ্রমিক লীগের নেতা। দল ক্ষমতায় আসার পর সফল উদ্যোক্তা। এখন শিল্পপতি মূল ব্যবসা বস্ত্র উৎপাদন ও পোশাক রফতানি।
জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে গত তিনবছর দায়িত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব শেখ মো. ওয়াহিদ-উজ-জামান। গত ৭ ডিসেম্বর চেয়ারম্যান পদে তার মেয়াদ শেষ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে তারা আরো ঋণ চেয়েছিল, আমি দিইনি। এ কারণে আমি তাদের শত্রুতে পরিণত হয়েছি। আর ঋণের প্রায় সবই আগের চেয়ারম্যানের (আবুল বারকাত) সময় দেয়া।’
জনতা ব্যাংকের সাবেক এবং বর্তমান কয়েকজন ব্যাংকারও একই অভিযোগ করেছেন। এমনকি যারা বাংলাদেশের আর্থিক খাতের খোঁজখবর রাখেন, তারাও জানেন একজন গ্রাহককে এত অর্থ দেয়ার কথা। ইউনুস বাদলের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবুল বারাকাত এবং আমিনুর রহমানের নামও তারা বলেছেন। অধ্যাপক আবুল বারকাতের দাবি, ‘তার (ইউনুস বাদল) প্রতিষ্ঠানগুলো তো খুবই ভালো। পরিশোধেও ঠিক আছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নথিপত্র এক ব্যক্তির নামে না। এ কারণে এত ঋণ পেয়েছে।’
তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঋণ নেয়া কোম্পানির অধিকাংশই এননটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। বাকিগুলোও মো. ইউনুসের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। জনতা ব্যাংকের এখনকার পর্ষদের নথিতেও তাই। এ কারণেই জনতা ব্যাংক এখন এই ঋণ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন। ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা লুটকারী ইউনুস ওরফে বাদলের দাবি, ‘পুরো অর্থ দিয়ে ২২টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। কারখানাগুলোর সবই আন্তর্জাতিক মানের।’
জনতা ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০০৪ সাল থেকে জনতা ব্যাংকের শান্তিনগর শাখায় প্রথম ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহণ করে এননটেক্স গ্রুপের জুভেনিল সোয়েটার। ওই শাখার বেশি ঋণ দেয়ার ক্ষমতা না থাকায় ২০০৮ সালে জনতা ভবন করপোরেট শাখায় ঋণটি স্থানান্তর করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবুল বারাকাত হন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান। এ সময় ব্যাংকটির এমডি পদে ছিলেন আমিনুর রহমান। বিএনপি আমল থেকেই তিনি ব্যাংকটির এমটি। বিএনপি পরিচালনা পর্ষদের অন্যরাও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। চেয়ারম্যান-এমডির ছত্রছায়ায় থেকে এবং এদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে ২০১০ সাল থেকে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান খুলে ঋণসুবিধা নেয়া শুরু করে এননটেক্স গ্রুপ। এক ব্যক্তির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে এত টাকা দেয়ায় নতুন ঋণ দেয়ার সব সামর্থ্যই এখন হারিয়ে ফেলেছে জনতা ব্যাংক। এর আগে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (বর্তমানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) শাখা থেকে ২০১১ সালের দিকে হলমার্ক নামের গ্রুপটি বের করে নিয়েছিল সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। তাতে সোনালী ব্যাংক এখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
জনতা ভবন করপোরেট শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ থেকে দায়িত্বে আছেন আহমেদ শাহনুর রহমান। তিনি বলেন, ‘শাখার ঋণ দেয়ার সব সীমা শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু আদায়ের পেছনে ছুটছি।’
ভাগ্যবান উদ্যোক্তা
মো. ইউনুস (বাদল) একসময় ছিলেন বাসের কন্ডাক্টর। এর পর বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের সামান্য কর্মচারী। তবে দলীয় ছত্রছায়ায় ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ নয়, রীতিমতো অল্প ক’বছরে বটগাছ বনে গেছেন তিনি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এখন ২২টি প্রতিষ্ঠানের মালিক বাদল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মাত্র ৮ বছরের ব্যবধানে এমন উত্থান ‘সৌভাগ্যবান’ এ উদ্যাক্তার। এ সময় ব্যাংক যেমন ছিল উদারহস্ত, তেমনি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন সাবেক শ্রমিকনেতা ও বর্তমানে মন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রীর। সেই সাথে ব্যাংকের পর্ষদের বিতর্কিত চেয়ারম্যান আবুল বারাকাত ও এমডি আমিনুরের স্নেহধন্য ও সদস্যদের অনেকের আশীর্বাদও ছিল তার প্রতি। উদারতা ও আন্তরিকতা দেখাতে পিছিয়ে ছিলেন না ব্যাংকের কর্মকর্তারাও। এমনকি সিবিএ নেতারাও আছেন তার সঙ্গে। তাইতো সিবিএ নেতার বাড়িতে ২শ কোটি টাকায় মসজিদ বানিয়ে দিচ্ছেন বাদল। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ঋণ পেতে পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক করে দিতে ভূমিকা রেখেছিলেন সিবিএ সভাপতি রফিকুল ইসলাম। ১৯৭৩ সাল থেকে জনতা ব্যাংক কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ, জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত) সভাপতি তিনি। তার নামে করা বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে ২০১ গম্বুজ মসজিদ। এই মসজিদ হচ্ছে ওই নেতার টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল ইউনিয়নের দক্ষিণ পাথালিয়া গ্রামের বাড়িতে। মসজিদের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে ‘বাদল হেলিপ্যাড’। রফিকুল ইসলাম জানালেন, ‘মসজিদ বানাতে এতে ২৫০ কোটি টাকা লাগবে। এতে ইউনুস সাহেবের অনুদান শতকোটি টাকা ছাড়াবে।’ তবে ইউনুস বলেন, ‘সর্বোচ্চ আড়াই কোটি টাকা দিয়েছেন। সিবিএ সভাপতি সব সময় একটু বাড়িয়ে বলেন।’
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাই ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও দুদককে এতে সক্রিয় হতে হবে।’
যেভাবে ঋণ দিয়েছে ব্যাংক
জনতা ব্যাংকের একাধিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোম্পানিগুলোর নামে বিভিন্ন সময়ে কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হলেও টাকা পরিশোধ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে ব্যাংক নিজেই উদ্যোগী হয়ে বিদেশি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে অর্থ শোধ করে দিয়েছে। পরে গ্রাহক তা পরিশোধ করেনি। এভাবে নেয়া ঋণসুবিধার (নন-ফান্ডেড) সব অর্থই সরাসরি ঋণে (ফান্ডেড) পরিণত হয়েছে। আবার দৈনন্দিন ব্যবসা পরিচালনার জন্য নেয়া চলতি মূলধনও (সিসি ঋণ) ফেরত দেয়নি। ২০১৫ সালে এননটেক্স গ্রুপের ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের অনুমোদন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই পুনর্গঠিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে গ্রুপটিকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জনতা ব্যাংক। এ সুবিধার মানে হলো, প্রথমে শুধু কিস্তির টাকা পরিশোধ করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন না দেয়ায় বিষয়টি আটকে আছে। তবে এতে চুপ না থেকে এসব ঋণ পুনঃতফসিল করে দিয়েছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকের এমডি ছিলেন এসএম আমিনুর রহমান। ঋণের বড় অংশই দেয়া হয়েছে তার সময়ে। তিনি বলেন, ‘শাখা থেকে প্রস্তাব এসেছিল, পর্ষদ বিবেচনা করে ঋণ দিয়েছে। আমার তো ঋণ দেয়ার কোনো ক্ষমতাই ছিল না।’ জনতা ভবন করপোরেট শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে ২০১১ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন আবদুস ছালাম আজাদ। এখন তিনি এই ব্যাংকেরই এমডি। ঋণের বড় অংশই তিনি শাখা ব্যবস্থাপক থাকাকালীন সময়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনিও দাবি করেন, তার সময়ে খুব বেশি ঋণ দেয়া হয়নি। এমডি হয়ে আবদুস ছালামের নতুন বক্তব্য, ‘ঋণ কমাতে এননটেক্সকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অন্য ব্যাংকে চলে যেতে বলা হয়েছে।’
উদ্বিগ্ন বর্তমান পর্ষদ
মূলধনের দ্বিগুণ ঋণ দেয়ার পর ২০১৭ সালে এসে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে জনতা ব্যাংকের এখনকার পর্ষদ। পর্ষদ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে দফায় দফায় গ্যালাক্সি সোয়েটারসহ এননটেক্স গ্রুপের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সার্বিক চিত্র উপস্থাপন করতে বলে। বারবার সময় নেয়ার পর গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর পর্ষদের সভায় তা উত্থাপন করা হয়। এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে পর্ষদ। ঋণ প্রদান ও আদায় পরিস্থিতি দেখে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গত ১৭ জানুয়ারি, ২০১৮ এননটেক্সের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণসহ অন্য ব্যাংকে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এ নিয়ে মো. ইউনুস (বাদল) বলেন, ব্যাংক এখন অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়ায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। ব্যাংকের নির্দেশে ৮ প্রতিষ্ঠান অন্য ব্যাংকে স্থানান্তরের চেষ্টা চলছে। আগামী জুনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ভাই বিষয়টি দেখেছেন। তিনি ঋণ নিয়ে কোনো আপত্তি তোলেননি।’
বারাকাত-আমিনুরই ব্যাংকটি শেষ করে দিয়েছে
এক গ্রাহককে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে দেশের বৃহত্তম কেলেঙ্কারির পাশাপাশি চাতুর্যের আশ্রয়ও নিয়েছে জনতা ব্যাংক। ঋণ কম দেখাতে ব্যাংক তাদের নিরীক্ষিত বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব প্রতিষ্ঠানকে তিনটি পৃথক গ্রুপ বলে উল্লেখ করেছে। নিয়মনীতি ভেঙে এক গ্রাহককে বেশি ঋণ দেয়ার তথ্য লুকাতেই এই চাতুরীর আশ্রয় নেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেয়া প্রতিবেদনেও ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণকে তিনটি পৃথক গ্রুপ হিসেবে দেখিয়েছে জনতা ব্যাংক। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রশ্ন তোলেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। ব্যাংকটির নিরীক্ষিত বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘জনতা ব্যাংক একসময় সেরা ব্যাংক ছিল। কিন্তু আবুল বারাকাতই ব্যাংকটি শেষ করে দিয়েছেন।’ ব্যাংকটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২ সালে গ্যালাক্সি গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ ছিল ৬৭৬ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের প্রতিবেদনেও বলা হয় এই গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ ১ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। তবে ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, এননটেক্স গ্রুপের ঋণ ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে ঋণ অনেক বেড়ে যাওয়ায় ওই বছরের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জ্যাকার্ড গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ ৩৭৭ কোটি টাকা, এননটেক্স গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের ঋণ ১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা ও এমএইচ গোল্ডেন জুট মিলের তিন প্রতিষ্ঠানের ঋণ ৪১৫ কোটি টাকা।
জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে তিন বছরের মেয়াদ গত ডিসেম্বরে শেষ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব শেখ মো. ওয়াহিদ-উজ-জামান। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন কী হবে, তা পর্ষদ দেখে না। কেন একটি প্রতিষ্ঠানের ঋণকে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের নামে দেখানো হলো, তা জানি না। তবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই এটি করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’ ওয়াহিদ-উজ-জামান আরো বলেন, ‘নতুন করে বড় কোনো ঋণ আমার সময়ে সৃষ্টি হয়নি। সব ঋণগুলো যে একজনের, অনেক তাগাদা দিয়ে শেষ পর্যায়ে তা পর্ষদে আনতে পেরেছিলাম। এটা এত দিন গোপন করার চেষ্টা হয়েছিল।’
৫ হাজার কোটি টাকা উদ্ধারই এখন বড় চ্যালেঞ্জ
এননটেক্স নামের এক প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। নিয়ম ভেঙে এক গ্রাহককেই মাত্র ৬ বছরে এ ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি। যা নিয়ে এখন তোলপাড় ব্যাংকপাড়াসহ দেশজুড়ে। ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুস ছালাম আজাদ বলেন, ওই অর্থ উদ্ধারই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘আমাদের গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় এখন ১০০ ভাগ কাজের ২০ ভাগই থাকবে ওই অর্থ উদ্ধারকে ঘিরে। সেভাবেই ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চকে বলে দেয়া হয়েছে। এটা আমাদের ব্যাংকিং খাতের জন্য চ্যালেঞ্জ।’ অবশ্য এই এমডিই তখন ব্যাংকটির করপোরেট শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন এবং পুরো ঋণ তার হাত দিয়েই ছাড় হয়েছে।
নীতিমালায় যা আছে
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, ব্যাংকগুলো কোন কোন ঋণকে একক গ্রুপ হিসেবে ধরবে, তা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা নীতিমালায় বলা আছে, ‘কোনো কোম্পানির মোট আয় বা ব্যয়ের ৫০ ভাগ বা তার বেশি যদি একক কোম্পানির সঙ্গে হয়, তাহলে উভয় সত্তাকে গোষ্ঠী বা গ্রুপ বিবেচনা করতে পারে। সে ক্ষেত্রেও উভয় কোম্পানিতে দেয়া ঋণসীমা একক সর্বোচ্চ গ্রাহকের আওতাভুক্ত হবে।’ এ ছাড়া রফতানি খাতে অর্থায়নের ক্ষেত্রে কোনো এক সময়ে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ঋণ মূলধনের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দেয়া যাবে। তবে এ ক্ষেত্রেও ফান্ডেড দায় মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি হবে না। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ অনুসারে ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের লক্ষ্যে একক গ্রাহক ঋণসীমা পুনর্র্নিধারণ করা হয়েছে। এখানে ফান্ডেড দায় বলতে ঋণগ্রহীতাকে দেয়া তহবিল এবং নন-ফান্ডেড দায় বলতে ঋণপত্র, গ্যারান্টি, স্বীকৃতি বা কমিটমেন্টের মাধ্যমে তহবিল সহায়তাকে বোঝানো হয়েছে। এসব লঙ্ঘন করেই এননটেক্স সংশ্লিষ্ট ২২ প্রতিষ্ঠানের ঋণ কম দেখাতে পৃথক পৃথক গ্রুপ তৈরি করা হয় যাকে শুধু পুকুর চুরিই নয়, সাগরচুরি বললেও অত্যুক্তি হবে না।
আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ হবে কি?
একক ব্যক্তির ঋণে বৃহত্তম কেলেঙ্কারির বিষয়ে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়ার কথা বললেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আবুল বারাকাত (জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান) এত টাকা দিয়েছেন, আমি তো জানিই না। আমি জানি যে তার সময়ে বড় বড় বেনামি ঋণ দেয়া হয়েছে। ৩০০ কোটি, ৪০০ কোটি টাকা এবং খারাপ উদাহরণও তৈরি হয়েছে।’ একক ব্যক্তিকে এত টাকা ঋণ দিয়ে জনতা ব্যাংক বিপদে পড়েছে-এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কই, আবুল বারাকাতকে তো দেখলাম ডিফেন্ড করেছেন।’ এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেন, ‘হ্যাঁ, আমিই তাকে (আবুল বারাকাততে চেয়ারম্যান) নিয়োগ দিয়েছিলাম।’ এ বিষয়ে এখন কী করা হবে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এখন আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে।’ জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বারাকাত বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, ‘ঋণ গ্রহীতা ভালো পার্টি।’ এ কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, জনতা ব্যাংক একক গ্রাহককে ঋণসীমা অতিক্রম করে ব্যাংকের মূলধনের দ্বিগুণ ঋণ দিয়েছে। এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।
এর সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো আইনী পদপেক্ষ নেয়া হয়নি। ফলে দেশে ব্যাংকিংখাতে সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা-তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
সূত্র: শীর্ষকাগজ