স্বামী মিজানুর রহমান চৌধুরী যখন মুক্তিযুদ্ধে যান তখন দেলোয়ারা বেগমের পেটে ছয় মাসের সন্তান। স্বামী আর ফেরেননি। ভাইদের সাহায্যে বড় করেছেন সন্তানকে। পারিবারিক সম্পত্তি আর ব্যবসায় যুক্ত হয়ে বেশ সচ্ছলভাবে পরিবারটি চালিয়ে নিচ্ছিলেন দেলোয়ারার ছেলে সজল চৌধুরী। কিন্তু গত রোববার রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসায় ঢুকে ‘ডিবি’ পরিচয়ধারী একদল লোক সজলকে ধরে নিয়ে যায়। বুধবার রাতে দেলোয়ারা নিজেই প্রথম আলোকে এসব তথ্য জানান।
ছেলের খোঁজে হন্যে হয়ে ভাটারা থানার পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা পুলিশসহ (ডিবি) বিভিন্ন জায়গায় গিয়েও ন্যূনতম কোনো সাড়া বা তথ্য পাননি ষাটোর্ধ্ব দেলোয়ারা। পরিবারের সবকিছুই ছিল সজলের হাতে। তিনি অপহৃত হওয়ার পর পরিবারের কাছে প্রতিদিনের সংসার চালানোর মতো টাকাও নেই।
অপহৃত সজল চৌধুরী (৪৭) জাহাজভাঙা, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ব্যবসায় যুক্ত। ধনাঢ্য বলা যায়। বেশ কয়েক বছর আগে সজলের স্ত্রী মারা গেছেন। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার জি ব্লকে একটি ছয়তলা ভবনের দোতলায় মা দেলোয়ারা ও কিশোর ছেলেকে নিয়ে ভাড়া থাকেন সজল।
বুধবার রাতে সজলের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, জিনিসপত্র এলোমেলো। মা দেলোয়ারা, সজলের কিশোর ছেলে, ছেলের গৃহশিক্ষক এবং একজন শুভাকাঙ্ক্ষী বাসাটিতে রয়েছেন। বাসার দেয়ালে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনসহ সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোকের সঙ্গে তোলা পারিবারিক ছবি টাঙানো। সজলের ব্যবহার করা নিসান পেট্রল জিপটি পড়ে আছে বাসার সামনের রাস্তায়। তাঁর আরেকটি শখের জিপগাড়িও গ্যারেজে রয়েছে।
বাসার ফটকে সিসি ক্যামেরা থাকলেও অপহরণকারীরা চলে যাওয়ার সময় সব ফুটেজ নিয়ে গেছে। নিরাপত্তাকর্মী মো. এমদাদ জানালেন, অপহরণকারীরা তাঁর কোমরে লাথি মেরে ফুটেজ চায়। এরপর তাঁকে জিম্মি করে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংরক্ষণের ডিভিআর বক্সটি নিয়ে চলে যায়। তিনি বলেন, লোকগুলো তাঁকে অস্ত্র দেখিয়েছে। চিৎকার করলে গ্রেপ্তার করে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছে।
দোতলায় সজলের বাসার ভেতরে ঢুকতেই কেঁদেকেটে জড়িয়ে ধরেন দেলোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, তাঁরা বাসা পরিবর্তন করে উত্তরায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রোববারই তাঁদের জিনিসপত্র সরানোর কথা ছিল। এমন সময়ই সজলকে অপহরণ করা হয়।
দেলোয়ারা বলেন, চট্টগ্রামে জাহাজভাঙাসহ বেশ কিছু ব্যবসা রয়েছে সজল চৌধুরীর। সম্প্রতি তাঁর এক ব্যবসায়িক অংশীদারের সঙ্গে লেনদেন নিয়ে ঝামেলা চলছিল। ওই অংশীদার সজলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সজলও আদালতে পাল্টা মামলা করেন। সেই ঘটনার জের ধরেই সজলকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে মনে করেন দেলোয়ারা।
রোববারের অপহরণ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে দেলোয়ারা বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে আটটা নাগাদ হবে। তাঁরা বাড়ি বদলের জন্য জিনিসপত্র গোছগাছ করছিলেন। ট্রাকের চালক এসেছে বলে নিরাপত্তাকর্মী এসে জানালেন। এ সময়ই ১৫-১৬ জন সাদাপোশাকের লোক হুড়মুড় করে বাসায় ঢুকে পড়ে। তারা নিজেদের ‘ডিবির লোক’ বলে পরিচয় দেয়। বাসায় ঢুকেই তারা সজলকে বেঁধে ফেলে মারধর করে। সজল তখন চিৎকার করে বলছিলেন, ‘মা আমারে বাঁচাও, আমারে মাইরা ফেলব।’
নিজের অসহায়ত্বে কেঁদে ফেলেন দেলোয়ারা। বলেন, ‘আমি আর পারি ষণ্ডামার্কা এতোগুলান লোকের সঙ্গে। চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার পোলাডারে নিয়া গেলো। কিন্তু তাদের পরনে ডিবির কোটি জ্যাকেট ছিল না। আমি তাদের কইছি তোমরা ডিবি না, গুণ্ডা। কিন্তু আটকাইতে পারি নাই।’
বাড়ির অন্য ঘরে তখন সজলের স্কুলপড়ুয়া ছেলে ঘুমাচ্ছিল। সে কিছুই টের পাওয়ার আগেই সজলকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাড়িটির নিরাপত্তারক্ষী মো. এমদাদ বলেন, সন্ধ্যার দিকে বাসা বদলের জন্য ট্রাকের চালক এসেছিলেন। এ সময়ই খোলা দরজা দিয়ে কয়েকজন বাসায় ঢুকে দোতলায় সজলের বাসায় উঠে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা হাতকড়া দিয়ে সজলকে বেঁধে নিচে নামিয়ে অপেক্ষমাণ দুটি মাইক্রোবাসে উঠে চলে যায়।
দেলোয়ারা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, অপহরণরে পর তিনি ভাটারা থানায় ছুটে যান। কিন্তু থানার পুলিশ তাঁদের জিডিও নেয়নি। তারা ডিবি বা র্যাবের কার্যালয়ে খুঁজতে যেতে বলে। এর পরদিন দেলোয়ারা মিন্টো রেডে ডিবির কার্যালয়ে গেলেও ভেতরেই ঢুকতে পারেননি। বাইরে থেকেই তাঁকে ও তাঁর নাতিকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। র্যাব-১-এর কার্যালয় থেকেও কোনো সাড়া দেওয়া হয়নি। অপহরণকারীরা যাওয়ার সময় সজলের মুঠোফোন বা অন্য কোনো কিছুই নেয়নি। মঙ্গলবার রাতে ভাটারা থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) শাহীন মোহাম্মদ আমানুল্লাহ বাসায় এসে সজলের একটি মুঠোফোন নিয়ে গেছেন।
তবে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে তাঁর কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। তিনি বিষয়টি জানেনও না। এসআই শাহীন ওই বাসায় গিয়েছিলেন জানালে ওসি বলেন, তিনি শাহীনের কাছ থেকে জেনে এ বিষয়ে জানাবেন।
যোগাযোগ করা হলে এসআই শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর শুনে সেখানে গিয়েছিলেন। তদন্তের জন্য সজল চৌধুরীর দুটো মুঠোফোনই আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গিয়ে দেখেন তাঁর কিশোর ছেলে একটি মুঠোফোনের সিমকার্ড খুলে ব্যবহার করা শুরু করেছে। পরে তিনি একটি ফোনই নিয়ে আসেন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলেও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি।
সজল চৌধুরীর বাসার দেয়ালে ছবি দেখে যোগাযোগ করা হয় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সজলের মা দেলোয়ারা মহিলা আওয়ামী লীগ করতেন। সজলও তাঁর কাছে মাঝেমধ্যে আসতেন। তবে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর কোনো মামলা বা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়নি শুনে অবাক হন সাহারা খাতুন। তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে জানান।
বাড়িতে পর্যাপ্ত খাবারও নেই
পরিবারটির প্রাণ ছিলেন সজল চৌধুরী। সম্পত্তি, ব্যবসা, বাসার বাজার সবই তিনি করতেন। মা দেলোয়ারা কিংবা কিশোর ছেলের কাছে কোনো টাকাই থাকত না।
দেলোয়ারা বলেন, সজলের দুটি গাড়ি থাকলেও সেগুলোর কোনো চালক নেই। তিনি অপহরণের শিকার হওয়ার পর দেলোয়ারার হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যালয়গুলোতে যাওয়ার মতো গাড়ি ভাড়ার টাকাও নেই। এমনকি বাসায় পর্যাপ্ত খাবারও নেই। বাসায় কিছু চাল আর এক গ্যালন তেল রয়েছে বলে জানান। সজল চৌধুরীর টাকা-পয়সা, ব্যাংক হিসাব সম্পর্কে দেলোয়ারা বা সজলের কিশোর ছেলের কোনো ধারণা না থাকায় তাঁরা বিপদে পড়েছেন।
সূত্র: প্রথম আলো