শওকত হোসেন
মালিকদের চাপে সরকার এই যে নানা সুবিধা দিল, তাতে ব্যাংক খাতে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার সরবরাহ বাড়বে। তবে সুদহার আপাতত কমছে না। নির্বাচনী বছরে উদ্যোক্তারা নানা অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগেও খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে ব্যাংক খাতে বাড়তি অর্থ মূল্যস্ফীতি ঘটাবে বলে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা। পাশাপাশি অর্থ পাচারেরও সুযোগ বাড়বে। নির্বাচনের বছরে এমনিতেই অর্থ পাচার বাড়ে। সুতরাং, এত সব উদ্যোগের পেছনে সন্দেহ থাকা স্বাভাবিক।
ব্যাংক খাতে এ ধরনের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব দেশই ব্যাপক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও আলাপ-আলোচনা করে থাকে। তা ছাড়া এ জাতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের। ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে মুদ্রানীতি নিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনাও ব্যতিক্রমী।
গতকাল অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাংকারদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোর কথা হয়েছে। ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে এভাবে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনায় তাঁরা বিস্মিত। তাঁরা মনে করছেন, এর পেছনের কারণ অর্থনীতি নয়, বরং রাজনৈতিক। মূল কারণ ব্যাংক মালিকদের সুবিধা দেওয়া। ১০ হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়াই বড় উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ
বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কয়েকটি কাজ আছে। যেমন মুদ্রা সরবরাহ ঠিক রাখতে সহায়ক মুদ্রানীতি প্রণয়ন, ব্যাংক পরিদর্শন, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন ইত্যাদি। এই কাজগুলো কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে না পারলে এ প্রতিষ্ঠান রাখা বা না রাখা তো সমান কথা। দেখা যাক, বাংলাদেশ ব্যাংক এসব কাজের কতটা করতে পারছে।
দেশে যা হলো
বর্তমান সরকার এ পর্যন্ত নয়টি নতুন ব্যাংক দিয়েছে। নতুন আরও দু-তিনটি ব্যাংক দেওয়ার কথাও আলোচনা হচ্ছে। এর পেছনে অর্থনীতি নেই, আছে রাজনীতি। অর্থমন্ত্রী নিজেই জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্যাংক দেওয়ার কথা বলেছেন। এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ভূমিকাই নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজটি কেবল সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে ব্যাংক অনুমোদনের চিঠি দেওয়া। নতুন ব্যাংক না দেওয়ার জন্য অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মত ছিল। তারপরও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অনুমোদনের চিঠি দিতে বাধ্য হয়েছে। কেবল একটি চিঠি লেখার জন্য তো বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন যে খুবই বেহাল, তার প্রমাণ একের পর এক ব্যাংক কেলেঙ্কারি। ২০০৯ সাল থেকে এর শুরু। হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি—একের পর এক কেলেঙ্কারি ঘটছেই। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের কেলেঙ্কারি তো আছেই, বাদ নেই বেসরকারি ব্যাংকও। যে অল্প কিছু বেসরকারি ব্যাংক ভালো করছে, তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃতিত্ব কতখানি, সে প্রশ্ন তোলাই যায়। যেসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভালো, ব্যাংকটিকে যারা ভালো রাখতে চায়, তারাই ভালো করেছে। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন-ব্যবস্থা না থাকলেও তো চলে।
ব্যাংক পরিদর্শন বা তদারকির কাজটা তখন কে করবে? অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকেই এ দায়িত্ব দেওয়া যায়। বর্তমান সরকার বন্ধ করে দেওয়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ নতুন করে তৈরি করেছে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণের জন্য। অনেকে হয়তো বলবেন, তাদের তো যোগ্য লোক নেই। পাল্টা প্রশ্ন করে বলা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ্য লোক থেকেই-বা লাভটা কী? কাজটা তো তারা করছে না বা করতে পারছে না।
বাকি রইল মুদ্রানীতি প্রণয়ন। এটিও তো আর হাতে রইল না। গত শুক্রবার ও রোববার অনুষ্ঠিত দু-দুটি বৈঠক থেকে এ কথা বলাই যায়। বিষয়টি অন্যভাবেও দেখা যায়। আমরা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে পারি, মুদ্রানীতি প্রণয়নে বাংলাদেশ নতুন একটি মডেল তৈরি করেছে। পাঁচতারা হোটেলে বসে, ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে মুদ্রানীতি তৈরি করা সম্ভব। মুদ্রানীতির বিভিন্ন উপকরণ এভাবে ঠিক করার ইতিহাস বিশ্বে সম্ভবত কোথাও নেই। বলা যায়, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে নতুন ইতিহাস রচনা করল।
একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় কাজ মূল্যস্ফীতিকে মাথায় রেখে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে কয়েকটি অস্ত্র দেওয়া থাকে। এর অন্যতম হলো নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) আর বিধিবদ্ধ জমা সংরক্ষণ (এসএলআর)। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোকে নিয়ম মেনে আমানতের একটি অংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। বর্তমানে সিআরআর হার হচ্ছে সাড়ে ৬ শতাংশ এবং এসএলআর ১৩ শতাংশ। মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই দুই হার কমায়, নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে বাড়ায়। এ সিদ্ধান্ত কারা কীভাবে নেয়? বিশ্বে এর একটি মান্য নীতি আছে। তা হলো সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এটিই ঘোষিত নীতি। আর এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়।
বাংলাদেশে এবার কী হলো? সিআরআর ১ শতাংশ কমানো হলো ব্যাংক মালিকদের চাপে, তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করে। বাধ্য করা হলো বাংলাদেশ ব্যাংককে। আরও অদ্ভুত কথা হলো, সিআরআর কমানোর এ সিদ্ধান্তের প্রভাব বিশ্লেষণ করা হবে আগামী জুনে। অর্থাৎ আগে বাস্তবায়ন, তারপরে প্রভাব বিশ্লেষণ। আরও অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার হলো, প্রভাব বিশ্লেষণ করার এই প্রস্তাবও ব্যাংক মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস বা বিএবির অন্যতম সদস্য সালমান এফ রহমানের, বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়। সুতরাং, এভাবেই যদি মুদ্রানীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক রেখে কী লাভ? শুধু শুধু খরচ।
আমানতকারীদের কী হবে
ব্যাংকের মোট মূলধনের ৯০ শতাংশই আসে আমানতকারীদের কাছ থেকে। ১০ শতাংশের মালিকানা বিএবির সদস্যদের। কিন্তু তাঁদের হাতে আছে আলাদিনের সেই আশ্চর্য প্রদীপ, যার নাম রাজনৈতিক প্রভাব। চাওয়ামাত্রই সব মেলে। আমানতকারীদের স্বার্থ দেখার কেউ এখানে নেই। অর্থনীতির তত্ত্ব বলে, ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সিআরআর-এসএলআর রাখার অর্থ হলো আমানতকারীদের এ পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গচ্ছিত আছে। আমানতকারীদের স্বার্থেই তা করা হয়। অথচ নির্বাচনের বছরে এসে সরকার গুরুত্ব দিল ১০ শতাংশ মালিকদের স্বার্থ। ভোটার হিসেবেও আমানতকারীদের যেন কোনো মূল্য নেই।
তাদের আবদার
দেশে খেলাপি ঋণ বহু আগেই এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলধন সংকট প্রকট। বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয় হয় অবস্থা। এর জন্য দায়ী মূলত সরকারের কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতা, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দুর্নীতি, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের অব্যাহত সুবিধা দেওয়া এবং ব্যাংক কেলেঙ্কারির নায়কদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া। ফলে সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাত বড় সংকটে পড়ে আছে। দুই দফায় এই সরকারের ১০ বছর মেয়াদ ব্যাংক কেলেঙ্কারির দশক হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
অবশ্য ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবি আবদার করেছে, ‘ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না’র মতো কেলেঙ্কারির ইতিহাসও লেখা যাবে না। অর্থমন্ত্রীকে তারা এ নিয়ে লিখিত প্রস্তাবও দিয়েছে। ব্যাংক খাত নিয়ে নেতিবাচক লেখালেখি বন্ধ করার জন্য আলাদা একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। তার তদারকি করবে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। যাক, বিএবি অন্তত একটা কাজের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে উপযুক্ত ভেবেছে। ব্যাংক মালিকদের সংগঠনের এ আবদারও ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। অবশ্য বৈঠকে অর্থমন্ত্রীর দুই পাশে বসে থাকা বিএবির নেতৃত্বের দিকে তাকালে বোঝা যায়, এ প্রস্তাব তাঁদের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। জমি দখল, অস্ত্র হাতে মিছিল, ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়ে অঘটন ঘটিয়ে চলা, প্রায় চার দশকজুড়ে খেলাপির শীর্ষস্থান ধরে রাখা, একের পর এক সুবিধা পাওয়া, অনিয়মের ঢল। এ এক অশেষ তালিকা। তারা সবই করবে, কিন্তু লিখলেই আপত্তি।
কিন্তু লেখালেখিতে নয়, বিপদ অন্য জায়গায়। সরকার, মালিক আর নিয়ন্ত্রক—সব এক হয়ে গেলে এর চেয়ে বড় বিপদ দেশের অর্থনীতিতে আর হতে পারে না। সে বিপদনাট্যের প্রথম অঙ্কের প্রদর্শনী হলো গত রোববার, ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠকটিতে। এখান থেকে ব্যাংক খাতের উদ্ধার কোথায়, সে পথটি বের করাই এখন বেশি জরুরি। নইলে সামনে মহাবিপদ।
সূত্র: প্রথম আলো