রাজধানীর মানিকনগরের একটি চায়ের দোকান। সারিবদ্ধভাবে বসে আছেন ২০/২৫ জন রিকশা চালক, দিনমজুর ও নানা পেশার মানুষ। দোকানের এক কোণে কাঠের বক্সে ২১ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশন। চলছে বিজ্ঞাপন বিরতি। চা বিক্রেতা হাশেম তখন দম ফেলার ফুরসৎ পাচ্ছিলেন না। টানটান উত্তেজনা।
মাঠের ভেতরে গ্যালারিতে বসা দর্শকরা তখন হাতজোড় করে প্রার্থনা করছেন। কি হবে, কি হতে যাচ্ছে। আইপিলের ৯ম ম্যাচ। মুম্বই ইন্ডিয়ানস বনাম দিল্লি ডেয়ারডেভিলস। ২০তম ওভারের খেলা। দিল্লির সামনে ১৯৫ রানের লক্ষ্যমাত্রা। শেষ ৬ বলে প্রয়োজন ১১ রান। দুই দলের মধ্যে চলছে নানা হিসাব নিকাশ। ব্যক্তিগত ৮০ রান নিয়ে ব্যাট হ্যাতে প্রস্তুত জেসন রয়। অপর দিকে মুম্বই অধিনায়ক রোহিত শর্মার চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে কার হাতে তুলে দিবেন বল। শেষমেশ বল পেলেন বাংলাদেশি তারকা মোস্তাফিজুর রহমান। টিভির স্ক্রিনে যখন দেখাচ্ছিল মোস্তাফিজুর রহমানকে। তখন ওই চায়ের দোকানে শুরু হয় হৈ-হুল্লোড়। এ যেন অন্য রকম এক উত্তেজনা। জুয়াড়িদের মধ্যে শুরু হয় নতুন হিসাব-নিকাশ। মোস্তাফিজের প্রতি ডট বলের জন্য ১ হাজার। চার ছক্কা খেলে ২ হাজার। মুম্বই জয়ী হলে ১০ হাজার। হারলে ২০ হাজার। মোস্তাফিজ উইকেট পেলে ২ হাজার। ঠিক এভাবেই ভাগ হয় মোস্তাফিজের শেষ ৬ বলের হিসাব নিকাশ। সেখানে কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে বাজির দর এমনটাই ধরা হয়। খেলা শেষে অবশ্য অনেক হাসিমাখা মুখগুলো মলিন হয়ে যায়। কারণ প্রথম দুই বলে মোস্তাফিজ দেন ১০ রান। তারপর টানা তিন বল ডট। পরের বলে মোস্তাফিজ ১ রান দিয়ে জয় তুলে দেন দিল্লির কাছে।
শুধু মানিকনগরের হাশেমের চায়ের দোকান নয়। সারা দেশে আইপিএল নিয়ে জুয়ায় মেতেছে হাজার হাজার জুয়াড়ি। বিশেষ করে আইপিএলের এবারের আসরে বাংলাদেশি দুই তারকা সাকিব আল হাসান ও মোস্তাফিজুর রহমান খেলাতে উন্মাদনা যেন একটু বেশি। ধারাবাহিক সাফল্য থাকায় এই দুই তারকার খেলা দেখতে বাঙালির যেমন আগ্রহ বেড়েছে তেমনি বেড়েছে জুয়াড়ির সংখ্যা ও জুয়ার আসর।
সরজমিন খিলগাঁও, বাসাবো, মালিবাগ, রাজারবাগ, মুগদা, সায়েদাবাদ, টিকাটুলী, দয়াগঞ্জ, গেণ্ডারিয়া, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, শ্যামবাজার, চকবাজার, তাঁতীবাজার, সূত্রাপুর, সোয়ারি ঘাট, রামপুরা, মধ্য বেগুনবাড়ি, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকা, কালশী, মিরপুর সাড়ে ১১, গাবতলী, বিহারী ক্যাম্প, মোহাম্মদপুর, বছিলা থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, ধানমন্ডির বেশকিছু স্থানে আইপিএল নিয়ে জুয়ার আসর দেখা গেছে।
চায়ের দোকান, হোটেল, রিকশা-গাড়ির গ্যারেজ, সেলুন, ক্লাব ও মহল্লা সর্বত্রই এখন আইপিএল জুয়া। পাশাপাশি ইন্টারনেট ভিত্তিক কিছু বিদেশি সাইটে জুয়ার আসর বসানো হয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে বিদেশি সাইটগুলো এই আয়োজন করে। ঘরে বসেই এসব বাজিতে অংশগ্রহণ করা যায়। তবে এক্ষেত্রে ডলারের মাধ্যমে হিসাব নিকাশ করা হয়। বাজি ধরার আগে এসব ওয়েব সাইটে ডলারের বিনিময়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হয়। অনেক সময় বিভিন্ন লিগ ভিত্তিকও আসর বসানো হয়। খেলা শুরুর আগে দর-দাম ঠিক করা হয়। আর এসব আসরে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশিরা। বিত্তবান অনেকেই এসব আসরে অংশগ্রহণ করছেন। কেউ লাভবান হচ্ছেন আবার কেউ নিঃস্ব হচ্ছেন।
মূলত এই বাজির ধরন হলো, পরের বলে দলীয় রান কত হবে, ব্যাটসম্যানের কত রান, পরের ওভারে উইকেট, পরের বলে চার না ছয়, ওভারে বোলার কয়টি উইকেট পাবে, কোন দল জয়ী হবে আর কে হারবে। মূলত এসব নিয়েই বাজি। সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকা বাজির খবরও বিগত বছরগুলোতে এসেছে। অভিজাত মহলে এবারও তার কমতি নেই। রিকশাচালক, গাড়ি চালক, দিনমজুর, শ্রমজীবী, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ- সবারই জুয়ার নেশা। আর এতে করে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকে। জুয়ার নেশায় পড়ে অনেকেই তাদের মূল্যবান সামগ্রী হারাচ্ছেন। জুয়ায় হেরে পরিবারের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে স্ত্রীর স্বর্ণালঙ্কার এমনকি সুদে টাকা আনছেন কেউ কেউ।
ভয়ানক তথ্য হচ্ছে গত বছর ক্রিকেট নিয়ে জুয়াকে কেন্দ্র করে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। গত বছরের ২২শে সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে জুয়া-বিরোধ নিয়ে এক যুবকের প্রাণ চলে যায়। একই বছরের ৫ই নভেম্বর বাড্ডায় বিপিএলের বাজির আসর বসতে না দেয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে খুন করা হয়। যদিও এ বছর এ ধরনের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে তো বাজিতে হেরে এক যুবক টাকা না দেয়ার পন্থা হিসেবে মিছামিছি হত্যার ভিডিও বন্ধুদের মাধ্যমে প্রচার করে ফেঁসেও গেছে।
পহেলা বৈশাখের রাতের ঘটনা। কলকাতা নাইট রাইডার্স আর হায়দরাবাদের খেলা। হায়দরাবাদের বাংলাদেশি তারকা সাকিব তখন অনেকটা মারমুখী। সাকিব অর্ধশতক করে আউট হবে নাকি আগেই আউট হবে এমনই বাজি ধরেন বাসাবোর সবজি বিক্রেতা দুই বন্ধু। বাজিতে জিতলে ৫ হাজার আর হারলে দিতে হবে তার ডাবল। শেষ পর্যন্ত সাকিবের ইনিংস ২৭ রানেই আটকে যায়। বাজিতে হেরে গিয়ে সবজি বিক্রেতা মামুনকে দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। কিন্তু তার পকেটে আছে মাত্র ৫০০ টাকা। হাতে আর কোনো টাকা নেই। বাজির নিয়ম অনুযায়ী সব টাকা নগদে পরিশোধ করতে হয়। উপায়ান্তর না পেয়ে মামুন সবজি বিক্রির ভ্যান তৈরির জন্য ক্ষুদ্র ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া ১০ হাজার টাকা তার বন্ধুকে দিয়ে দেন। একদিকে ঋণের টাকার কিস্তি আবার অন্যদিকে পরিবারের প্রতিদিনের খরচ। সব মিলিয়ে মামুন এখন অনেকটা হতাশ।
এমনই আরেক ঘটনা রামপুরার। কলকাতা ও হায়দরাবাদের ম্যাচের জয় নিয়ে বাজি ধরেছিলেন কলেজপড়ুয়া দুই বন্ধু হামিম ও রাবেদ। কলকাতা জিতলে হামিম পাবে রাবেদের স্যামসাং গ্যালাক্সি এস৬ আর হায়দরাবাদ জিতলে রাবেদ পাবে হামিমের অপ্পো এফ৩। প্রথম দিকে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়লেও শেষ পর্যন্ত জয় তুলে নেয় হায়দরাবাদ। তাই বাবার কাছে দীর্ঘদিনের দাবি পহেলা বৈশাখে পাওয়া অপ্পো-৩ তুলে দিতে হয়েছে তার বন্ধু রাবেদের হাতে। আইপিএলকে কেন্দ্র করে পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান আর হোটেলের বাজির বাইরে অভিজাত এলাকার চিত্র ভিন্ন। সেখানে ধরা হয় লাখ লাখ টাকার বাজি। বিশেষ করে ক্লাব ভিত্তিক বাজিতে শুধু টাকার খেলা। মিনিটেই কেউ সর্বোচ্চ খুইয়ে বসে আছেন আবার কেউ টাকা গুনে শেষ করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সহেলী ফেরদৌস মানবজমিনকে বলেন, এটা এক ধরনের ক্রাইম। তাই এ বিষয়ে আমাদের নজরদারি রয়েছে। গত বছর বেশকিছু অপ্রীতিকর ঘটনার কারণে এ বছর বাড়তি সতর্কতা নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সম্ভাব্য যেসব স্থানে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে ওই সব স্থানে পুলিশি নজরদারি রয়েছে। এছাড়া আমাদের কমিউনিটি পুলিশ দিয়ে তথ্য সংগ্রহ চলছে।
সহেলী ফেরদৌস আরো বলেন, পুলিশের পাশাপাশি জনগণকে সচেতন হতে হবে। কারণ এই ক্রাইম বন্ধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য কোথাও যদি জুয়ার আসর বসে তবে সচেতন মানুষ পুলিশের হট লাইন-৯৯৯ ও আমাদের মোবাইল নম্বরে ফোন করে জানাতে পারেন। অভিযোগ এলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
সূত্র: মানবজমিন