অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বাবার জন্য সন্তানের হাহাকার আর স্বামীর জন্য বিধবা স্ত্রীর আর্তনাদ– বাংলাদেশের অনেক ঘরেই এখন এই চিত্র। অতি সম্প্রতি ইংরেজী দৈনিক ডেইলী স্টার এরকমই একটি ফলোআপ স্টোরি করেছে, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার নিহত কাউন্সিলর একরামুল হকের হত্যাকান্ড পরবর্তী পরিস্থিতি ও পরিবারের প্রতিক্রিয়ার উপর। সেই খবরে বলা হয়েছে, নিহত হতভাগ্য কাউন্সিলর একরামের শিশুপুত্র নাহিয়ান এখনো ভয়ে মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে চিৎকার করে উঠে। ১২ বছরের মেয়েটি তখন দৌড়ে বাবার বিছানার কাছে চলে যায় আর বাবা বাবা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। একই অবস্থা তার বড় বোন তাহিয়াতের। ক্ষনে ক্ষনে বাবার কথা মনে করে ডুকরে কেঁদে উঠছে সেও।
গত বছরের ২৬ মে কথিত বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে র্যাব হত্যা করে কাউন্সিলর একরামকে। এরপর থেকে ৯ মাস কেটে গেছে। একরামের সন্তানেরা আজও বাবার মোবাইলে কল দিয়ে যায়, কিন্তু সেই কল কেউ রিসিভ করে না। প্রতি মাসের ২৬ তারিখে একরামের দুই সন্তানের কান্না আরো বেড়ে যায়। এই দিনটিতে তারা কিছু খেতেও চায় না, এমনটাই বলছিলেন একরামের বিধবা স্ত্রী আয়েশা বেগম।
তাহিয়াত এখন নবম শ্রেণীতে আর নাহিয়ান পড়ছে সপ্তম শ্রেণীতে। দুজনই প্রতিদিন বাবার মোবাইলে একবার হলেও ফোন দেয়, যদি কেউ ফোনটি রিসিভ করে, তাদেরকে নিহত কাউন্সিলরের কোন সন্ধান দেয়। কিন্তু কেউ সেই ফোনটি আর রিসিভ করেনা। সন্তানেরা ওদের মাকে বাবার কাপড়গুলো পর্যন্ত ধুতে দেয় না, কেননা তাতে পোশাক থেকে ওদের বাবার শরীরের ঘ্রাণটি চিরতরে হারিয়ে যাবে। আয়েশা জানান, বাচ্চারা অনেক সময় বাবার জামা কাপড় পড়েই ঘুমুতে যায়। তারা বাবার কাছে চিঠি লেখে। ডায়রীতেও অনেক কথা লিখে রাখে।
সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক ওদের লেখা ডায়রী ঘাটাঘাটি করছিলেন। একটি পাতায় তার চোখ আটকে যায়। নাহিয়ান লিখেছে, “বাংলাদেশে ন্যায় বিচার বলতে কিছুই নেই। আমি আমার দেশকে ঘৃণা করি। জীবনটা শুধুই দু:খ আর কষ্টে ভরা।”
এই বাচ্চাদুটো বাবার সাথে খুব বেশী ঘনিষ্ট ছিল। বাবাই ওদেরকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতো, কিছু কিনে দিতো, খাবার খাওয়াতো। এখন এসবই স্মৃতি। একরামের মৃত্যুর পর এখন তাদেরকে আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে দান সদাকা নিয়ে সংসারের খরচ মেটাতে হচ্ছে। অথচ এখনো, এই দু:সহ পরিস্থিতির মধ্যেও এই পরিবারটিকে নিয়মিত হুমকি দেয়া হচ্ছে। প্রায়ই একদল মানুষ এসে তাদেরকে হুমকি দিয়ে যায় যাতে তারা মুখ না খোলেন এবং কাউকে বিশেষ করে মিডিয়ার সামনে কিছু না বলেন।
একরামের বড় ভাই নজরুল জানান, আমরা আজ অবধি একরামের হত্যায় পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মামলা করতে পারিনি। কোন আইনজীবী আমাদের পক্ষে মামলা করার সাহস পাচ্ছে না। এর আগে আমরা একজন আইনজীবীকে রাজি করিয়েছিলাম কিন্তু আমরা সেই আইনজীবীর চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসার পর কেউ মনে হয় তাকে কিছু বলেছিল, তাই তিনি পরে ফোন দিয়ে আমাদেরকে এই মামলা করতে তার অপরাগতার কথা জানিয়ে দেন। এমনকি আগে যেই রাজনৈতিক নেতারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, এখন তারাও আমাদেরকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য হুমকি দিচ্ছেন।
তবে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী নুরুল বাশার নিহত পৌর কাউন্সিলর একরামের পরিবারকে তার বা তার দলের পক্ষ থেকে কোন ধরনের হুমকি দেয়ার কথা অস্বীকার করেন।
র্যাব ক্রসফায়ারে একরামকে হত্যা করার পর মিডিয়াকে জানিয়েছিল যে, নিহত কাউন্সিলর এই এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। কিন্তু একরামের পরিবার তা অস্বীকার করেন। তারা বলেন, একরাম ১৩ বছর টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার অবস্থান বরাবরই ছিল মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে। এলাকার মানুষই সেই স্বাক্ষ্য দেবে।
একরামের স্ত্রী আয়েশা জানান, একরামের হত্যার পর দুজন মন্ত্রী তাদেরকে ফোন দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এমনকি তারা পরিবারের সম্ভাব্য সাক্ষাতপ্রার্থীদের নামও লিখে নিয়েছিলেন। তবে ৯ মাস পার হলেও সেই সাক্ষাতের কোন ব্যবস্থা আজও হয়নি।
একরামের হত্যার পর তার স্ত্রী কক্সবাজার প্রেসক্লাবে গত বছরের ৩১ মে তারিখে একটি সংবাদ সম্মেলনে একটি মোবাইল ফোনালাপ ফাঁস করেছিলেন। তিনি সাংবাদিকদেরকে ৪টি মোবাইল রেকর্ডেড আলাপও হস্তান্তর করেন যারা তীব্রগতিতে দেশের ও বিদেশের মিডিয়ার কল্যানে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্রায়ই দুর্বৃত্তরা তাকে ফোন দিয়ে সেই ক্লিপটি দিয়ে দেয়ার জন্য হুমকি দেন। এমনকি অর্থের প্রলোভোন দেখিয়েও বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে।
ঐ মোবাইল রেকর্ডের একটি ক্লিপের একপাশে আয়েশার চিৎকার আর অন্যপাশে গুলির শব্দ শোনা যায়। আয়েশা জানান, একরামই তাকে কলটি দিয়েছিলেন এবং শেষ মুহুর্তে পর্যন্ত কিছু জানানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু একরাম আর কথা বলতে পারেননি, কিন্তু ফোনটা পকেটে রেখে দিয়েছিলেন ফলে ফোনের অপরপ্রান্তে আয়েশা সেই গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন।
একরাম হত্যার পর র্যাব বাদী হয়ে একটি মামলা করলেও পুলিশ এখনো খুবই দায়সাড়াভাবে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আয়েশা বেগম জানান, তারা পুলিশের কাছে ৪টি মোবাইল ক্লিপ দিলেও পুলিশ মাত্র একটি ক্লিপকে জব্দ তালিকার অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাকি তিনটা তারা গ্রহন করতেই রাজী না। এই বিষয়ে টেকনাফ থানা পুলিশের ওসি প্রদীপ কুমার দাসের সাথে কথা বললে তিনি জানান, “একরামের পরিবারের কাছে গুরুত্বপূর্ন কোন তথ্য থাকলে তারা আমাদেরকে দিতে পারে।”
কিন্তু পুলিশ এটুকু বলেই খালাস। আজ অবধি আইন শৃংখলা বাহিনীর কেউ এই মামলার কোন কাজে একরামের পরিবারের সাথে যোগাযোগই করেনি।
একরামের পরিবার আজও ভয়াবহ আতংক আর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। বাস্তবতা হলো, শুধু একরামের পরিবার নয়, বিচার বহির্ভুতভাবে দেশের আনাচে কানাচে যাদেরকেই হত্যা করা হয়েছে, গুম বা অপহরন করা হয়েছে তারাই এখন আছে ভীষন রকম নিরাপত্তাহীনতায়। দেশে আইন কানুন, সুশাসন বা মানবাধিকার সবই কাগজে কলমে থাকলেও তার কোন সুবিধাই এই মানুষগুলো কিংবা এদের পরিবারগুলো পায় না । তাই মজলুম মানবতা আজ সব ধরনের অনাচার আর অবিচারের সমাপ্তির অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।