অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
মাত্র কিছু দিন আগে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঘটে গেল এক ভয়াবহ বালিশ কেলেংকারির ঘটনা। বালিশ, বিছানা চাদর, চায়ের কাপ, কেটলি, চেয়ার টেবিল, লেপ-তোষক কেনায় এমনই সীমাহীন দুর্নীতি ছিল যে, হাইকোর্টের বিচারপতিরা পর্যন্ত এসব শুনে অবাক হয়ে গেছেন। নজিরবিহীন এই দুর্নীতির ঘটনায় সরকারের ওপর মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৌশলে এই দুর্নীতির দায় বিএনপির ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু, পরে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। মির্জা ফখরুল আসল গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন।
বালিশ কেলেংকারির সেই রেশ কাটতে না কাটতেই আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ঘটেছে বই কেলেংকারির ঘটনা। দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের জন্য বই কেনার নামে লুটপাট করা হয়েছে কোটি টাকা।
জানা গেছে, গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজের জন্য ১০টি বই কপি কিনেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বইটির বাজারমূল্য সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা হলেও স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রতিটি বই কিনেছে ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা করে। সেই হিসাবে ১০ কপি বইয়ের মোট দাম পরিশোধ করা হয়েছে ৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ, বাজার দামের তুলনায় ৮ লাখ টাকা বেশি খরচ করে এ বই কিনেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
শুধু এই একটি আইটেমের বই-ই নয়, দুটি টেন্ডারে ৪৭৯টি আইটেমের ৭ হাজার ৯৫০টি বই কিনেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এসব বইয়ের মূল্য বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৬ কোটি ৮৯ লাখ ৩৪ হাজার ২৪৩ টাকা।
রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজের জন্য ৩১৭টি আইটেমের ২৪৫৪টি বই ২ কোটি ৫০ লাখ ৯১ হাজার ২৮৫ টাকায় কেনা হয়েছে। এছাড়া, সারাদেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের জন্য ১৬২টি আইটেমের ৫৪৯৬টি বই কেনা হয়েছে ৪ কোটি ৩৮ লাখ ৪২ হাজার ৯৫৮ টাকায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের ২৬ ও ২৭ মে বই কেনার জন্য পৃথক দুটি টেন্ডার আহ্বান করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। প্রথম টেন্ডারের প্রাক্কলিত মূল্য ধরা হয় পাঁচ কোটি টাকা ও দ্বিতীয়টির প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। ৪ কোটি ৩৮ লাখ ৪২ হাজার ৯৫৮ টাকায় প্রথম টেন্ডারের ওয়ার্ক অর্ডার পায় হাক্কানী পাবলিশার্স। আর ২ কোটি ৫০ লাখ ৯১ হাজার ২৮৫ টাকায় দ্বিতীয় টেন্ডারের ওয়ার্ক অর্ডারও পায় একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষে এসব বই কেনার দায়িত্বে ছিলেন উপ-পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) ডা. শেখ মো. মনজুর রহমান, শিক্ষা চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন।
৪৭৯টি আইটেমের বইয়ের মধ্যে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে ৩০টি বইয়ের বাজার দাম যাচাই করেছে । বইয়ের বাজার দাম যাচাই করে দেখা গেছে, বইগুলো দ্বিগুণ, তিনগুণ কোনও ক্ষেত্রে ১৫ গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে।
সাতটি মেডিক্যাল কলেজের জন্য গ্রেজ অ্যানাটমি নামে ৯৫টি বই কেনা হয়েছে। বাজারে এই বইয়ের প্রতিটি কপির দাম ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা। কিন্তু একেকটি বই কেনার বিল করা হয়েছে ৪৩ হাজার টাকা করে। ৯৫টি বই কিনতে খরচ হয়েছে ৪০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ বাজার মূল্যের চেয়ে অন্তত সাতগুণ বেশি দামে বইটি কিনেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
বার্ন অ্যান্ড লেভি ফিজিওলজি বইটির ৬৫টি কপি কেনা হয়েছে দেশের পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজের জন্য। বাজারে বইটির দাম চার হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা। কিন্তু, মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিটি বই কেনা হয়েছে ২০ হাজার ৪৮০ টাকায়।
মুগদা মেডিক্যালের জন্য কেনা হয়েছে ‘অর্থোডোনটিক মেটারিয়াল সায়েন্টেফিক অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল অ্যাসপেক্টস’ নামে তিনটি বইয়। বাজারে বইটির দাম চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা হলেও কেনা হয়েছে ১৪ হাজার ১৭৫ টাকা করে।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্র্যাকটিক্যাল অপটামোলজি: ম্যানুয়াল ফর বিগেনার্স বইটি কেনা হয়েছে পাঁচ কপি। প্রতিটি বইয়ের বাজার মূল্য ২৯ হাজার টাকা। কিন্তু, প্রতিটি বই কেনা হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৫০ টাকা করে।
‘অর্থোফিক্স এক্সটার্নাল ফিক্সেশন ইন ট্রমা অ্যান্ড অর্থোপেডিকস’ নামের বইটির ১০টি কপি কেনা হয়েছে মুগদা মেডিক্যালের জন্য। এ বইয়ের বাজার দর প্রতিটি ১৪ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা। কিন্তু প্রতিটি বই কেনা হয়েছে ৩৩ হাজার ৭৫ টাকা করে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখত বরাবরই দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে পরিচিত। কিছু দিন আগেই তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আবজালের দুর্নীতির চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বিগত ১৫ বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকার মালেক হয়েছেন। তার এই দুর্নীতি নিয়ে সারাদেশে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু, এরপরও দুদকের চোখ ফাঁকি দিয়ে আবজাল দম্পতি দেশ থেকে পালিয়েছেন।
বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ওই সময় প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। জানা গেছে, এসব দুর্নীতির সঙ্গে তিনিও জড়িত আছেন। এখন তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী। দুর্নীতি এখন মন্ত্রণালয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছেছে। বিভিন্ন সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি বড় বড় কথা বললেও কার্যত দুর্নীতি বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ।