বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত কৃষি পণ্যের নাম হচ্ছে পেঁয়াজ। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করার একদিন পরই বাংলাদেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। ৩০-৪০ টাকা কেজি দরে কেনা পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে ২৫০-১৬০ টাকা কেজিতে। নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সকলের জীবনই পেঁয়াজের ঝাঁজে হয়েছে নাজেহাল।
নিজস্ব উত্পাদনের পাশাপাশি প্রতিবছর ভারত থেকে বেশ বড়ো পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ। উত্পাদন ঘাটতির কথা জানিয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য ৩০০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ন্যূনতম ৮৫০ ডলার করে দেয়। ফলে পরদিনই বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। পেঁয়াজের এই ঘাটতি পূরণে সরকার মিয়ানমার, মিশর, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ এনেছে। এগুলো সবই সাময়িক ঘাটতি বা সমস্যা মিটানোর পদক্ষেপ মাত্র। কিন্তু এর স্থায়ী সমাধানের পথ কি?
দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ না নিলে পেঁয়াজ নিয়ে এমন সংকট মাঝে-মধ্যেই তৈরি হতে থাকবে যা জনজীবনে দুর্ভোগ বয়ে আনবে, সেই সঙ্গে আনবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ঢাকায় বিভিন্ন বাজারে শনিবার পেঁয়াজ কেজি প্রতি ২৪০-২৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। অথচ আগস্ট মাসে একই পেঁয়াজ বাজারে পাওয়া গেছে কেজি প্রতি ৭০-৮০ টাকায়।
উনত্রিশে সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের পর পণ্যটির দাম এক ধাক্কায় বেড়ে ১২০-১৫০ টাকায় ঠেকে। এরপর দাম বাড়তেই থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে অভ্যন্তরিণভাবে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন করতে না পারলে যে কোন সময় এমন সংকট আবার দেখা দিতে পারে।
এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, চাইলেই কি পেঁয়াজের ওপর আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব?
টিসিবি বলছে, বাংলাদেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। বিপরীতে বাংলাদেশে বছরে ১৭ থেকে ১৯ লাখ টন পেঁয়াজ উত্পাদন হয়। ফলে দেশীয় চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতি বছর ৫ থেকে ৭ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়, যার ৯৫ শতাংশ আসে ভারত থেকে। তবে প্রতিবছরই এই আমদানির মাত্রা বাড়াতে হয় কারণ দেশে উত্পাদিত পেঁয়াজের মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশ নষ্ট হয় ব্যবস্থাপনার সংকটের কারণে। কাজেই পেঁয়াজ সমস্যার স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হলে আমাদের সবগুলো দিক খুঁটিয়ে দেখতে হবে আর এখনই এর উপযুক্ত সময়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জহিরুদ্দিন বলেছেন, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানো প্রয়োজন হলেও এই ফসল উৎপাদনে কৃষকদের বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়।
চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষক যতোটা আগ্রহী, পেঁয়াজের ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। কারণ চাল উৎপাদন অপেক্ষাকৃত লাভজনক।
যে জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়, সেই জমিতে অন্যান্য ফসলও ফলানো হয়, তাই বলা যায় যে জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদন একটি প্রতিযোগিতার মধ্য থাকে।
বাংলাদেশে সাধারণত শীতকাল পেঁয়াজ উৎপাদনের উপযোগী আবহাওয়া, এখন নতুন জাতের পেঁয়াজ গরমকালে উৎপাদন করা গেলেও সেগুলো বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না। এছাড়া বৃষ্টিপাতের কারণে জমিতে পানি জমে পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে পড়ে।
পচনশীল এই পণ্যটি সংরক্ষণ করা জরুরি হলেও বাংলাদেশে পেঁয়াজের জন্য উপযুক্ত কোল্ড স্টোরেজের যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে জানান মি. জহিরুদ্দিন। আলু যে কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা হয়। সেখানে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় না।
কারণ পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজে আর্দ্রতা লাগবে ৬০%, তাপমাত্রা লাগবে আট ডিগ্রী থেকে ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আলুর কোল্ড স্টোরেজে এই মাত্রাটা ভিন্ন থাকে। সব জমিতে পেঁয়াজের ফলন না হওয়াকে উৎপাদন কম হওয়ার কারণ হিসেবে মনে করছেন ড. জহিরুদ্দিন।
তিনি বলেন “পেঁয়াজের উপযুক্ত জমি হল মিডিয়াম হাইল্যান্ড, মিডিয়াম লো ল্যান্ড অর্থাৎ বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমের জেলাগুলোয় পেঁয়াজের ফলনটা ভাল হয়। কিন্তু সিলেট বা দক্ষিণে চট্টগ্রামের হাইল্যান্ড বা বেশি লো ল্যান্ডে এর ফলন হবে না। কারণ জমিতে পানি জমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে।”
জমিতে কোন ফসল ফলানো হবে সেটার সিদ্ধান্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কৃষকরা নেয়ায় বাজারে আকস্মিক সংকট দেয়া দেয় বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে কৃষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সরকার এবং ব্যবসায়ীরা চাল বা অন্যান্য শস্য উৎপাদনের দিকে যতোটা মনযোগী, তেমনটা পেঁয়াজ বা অন্য ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেখা যায়না।
রাজশাহীর কৃষক আসলাম হোসেন বলেন, “পেঁয়াজে মনে করেন লাভ কম। চালে প্রফিটটা বেশি। পেয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। একটু বৃষ্টি হলে জমিতে পানি ওঠে পচে যায়। লস হয় অনেক।”
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে ১৭ থেকে ১৯ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করে। যা কিনা পেঁয়াজের মোট চাহিদার ৬০%। চাহিদার বাকি ৪০% অথবা ৭ থেকে ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। আমদানির ৯৫% আসে ভারত থেকে। বাকি পেঁয়াজ আসে মিয়ানমার, মিশর, তুরস্ক থেকে।
পেঁয়াজ আমদানির ওপর ভারতের ওপর এই অতি নির্ভরশীলতার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পণ্যটি পচনশীল হওয়ায় কম সময়ের মধ্যে বাজারে ছাড়ার জন্য কাছের দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এতে পরিবহন খরচও অনেক কম পড়ে।
ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার পর বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় আশা করা হচ্ছিল দাম স্থিতিশীল হবে। কিন্তু এ’কদিন বাজারে পেঁয়াজের দাম কমেনি, উল্টো বেড়েছে।
পেঁয়াজের ওপর এই আমদানি নির্ভরশীলতাকে স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
তাদের মতে, একটি দেশ যে সব ধরণের ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এমন কোন কথা নেই।
আমদানি বন্ধের কারণে বাজারে যদি হঠাৎ সংকট দেখা দিলে, উৎপাদন বাড়ানোর পরিবর্তে বাজার মনিটরিংয়ের দিকে নজর বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. মোঃ কিসমাতুল আহসান।
তিনি বলেন, “সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসনকে মনিটর করতে হবে যে দাম বাড়ার আসল কারণটা কী? সেটা কি চাহিদা-যোগানের ভারসাম্যহীনতার কারণে হয়েছে নাকি ব্যবসায়ী ও মধ্যসত্ত্বভোগীরা আর্টিফিশিয়াল ক্রাইসিস তৈরি করেছে। কারণ লাগামহীন দাম বাড়ার সুযোগ কিন্তু অনেকে নিতে পারে, সুপার নরমাল প্রফিট করতে পারে। কিন্তু সেটা যেন জুলুমের পর্যায়ে না যায়।”
এই সংকটের বিষয়টি আগে থেকেই আঁচ করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যদি তড়িৎ পদক্ষেপ নিত, তাহলে পরিস্থিতি এতোটা লাগামহীন পর্যায়ে যেতো না বলে তিনি মনে করেন।
“বাজারে যে পেঁয়াজের সংকট রয়েছে সেটা অনুমান করে সরকারের আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। ভারত আমদানি বন্ধ করেছে ঠিক আছে। কিন্তু অর্ডার দিয়ে অন্য দেশ থেকে আনতে আনতেও তো অনেক সময় লাগে। জাহাজে করে আসতেও তো সময় লাগে। এবার আসলে সঠিক সময়ে তারা প্রেডিক্ট করতে পারেননি।”
মি. আহসানের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক।
তিনি বলেন, “ভারত যে হঠাৎ করে পেঁয়াজ দেয়া বন্ধ করে দেবে আমরা ভাবতেও পারিনি। তবে আমাদের আগে থেকেই অনুমান করা উচিত ছিল, আরও আগে উদ্যোগ নিলে হয়তো এমন অবস্থা হতো না। আমরা এখন চেষ্টা করবো উৎপাদন কিছুটা বাড়ানোর।”
পেঁয়াজ সংরক্ষণে কোল্ড স্টোরেজের অভাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোল্ড স্টোরেজে পেঁয়াজ রাখলেই দাম অনেক বেড়ে যাবে। তখন দাম ভারত থেকে আমদানিকৃত পেঁয়াজের চাইতেও অনেক বেশি হবে।
চলতি বছরে মৌসুমের আগে বৃষ্টিপাতের প্রভাব পেঁয়াজের ওপর পড়েছে বলে জানান মন্ত্রী।
কম সময়ে ফলন বেশি হয় এমন জাতের পেঁয়াজ উদ্ভাবন করতে পারলে অথবা বাংলাদেশের আবহাওয়ার জন্য উপযোগী পেঁয়াজের উচ্চ ফলনশীল বীজ আমদানি করা গেলে সংকট অনেকটা কাটানো সম্ভব বলে মনে করেন মি. জহিরুদ্দিন।
বর্তমানে পেঁয়াজের বাজারের সংকট দূর করতে পেঁয়াজের ব্যবহার কমানোর ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
“আমাদের যে খাদ্যাভ্যাস তার সবখানে পেঁয়াজ আছে। মাছ, মাংস থেকে শুরু করে ভর্তা ভাজি এমনকি মুড়ি মাখানোতেও পেঁয়াজ লাগে। এজন্যই এর ওপর এতো চাপ। কিন্তু পেঁয়াজ না খেলে চলবে না, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। পেঁয়াজ খাওয়া কমাতে হবে।”
এদিকে বাজার ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য রাখতে সরকারের উপযুক্ত মনিটরিং এবং ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা করার অসুস্থ মানসিকতা থেকে সরে আসলে এ ধরণের সংকট কাটানো সম্ভব হবে বলে মত দিয়েছেন মি. আহসান।
গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষেও কৃষকদের উত্সাহিত করা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করছেন কৃষিবিদরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে রবি ও খরিপ উভয় মৌসুমে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষ করা সম্ভব। শুধুমাত্র শীতকালীন পেঁয়াজ চাষের ওপর নির্ভরশীল না থেকে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষ পদ্ধতি ব্যাপকহারে কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা উচিত।
তারা বলছেন, কৃষকদের জানানো প্রয়োজন যে সারাবছর পেঁয়াজ চাষে তাদের অর্থনৈতিক লাভ বৈ ক্ষতি হবে না। সরকার প্রাথমিকভাবে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের জন্য কৃষকদের ভর্তুকি প্রদান করতে পারে। উচ্চফলনশীল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন পেঁয়াজের জাতগুলো কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল পেঁয়াজের গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন যে জাতগুলো উদ্ভাবন করেছে, সেগুলো নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ে ব্যাপকহারে কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে।
সর্বোপরি কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে “ওনিয়ন অ্যাকশন প্ল্যান” নেওয়া যেতে পারে। যার আওতায় থাকবে রবি মৌসুমে পেঁয়াজের উত্পাদন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে খরিফ মৌসুমে কৃষকদের পেঁয়াজ চাষের আগ্রহ বৃদ্ধির পরিকল্পনা। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের প্রসার ঘটানোর কর্মসূচি। রবি মৌসুমে উত্পাদিত পেঁয়াজ সংরক্ষণের স্থায়ী ব্যবস্থা।
কৃষিবিদরা বলছেন, আমাদের দেশে বছরপ্রতি পেঁয়াজের ঘাটতি আকাশছোঁয়া নয়। এটি আমাদের ধরাছোঁয়ার মধ্যেই আছে। সঠিক পরিকল্পনা আর তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ ঘাটতি পূরণ সম্ভব। আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করি। পেঁয়াজের ঘাটতি আমাদের এই স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবিতে চাঁদের কলঙ্কের মতো। সময়োপযোগী সরকারি আর বেসরকারি উদ্যোগ আর পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা এই কলঙ্কমুক্ত হতে পারি।
তথ্য সূত্র: বিবিসি ও ইত্তেফাক