অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বন্ধুত্বের সম্পর্ক আকাশ থেকে মাটিতে নামতে শুরু করেছে। গত অক্টোবর মাসে আসামে চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) প্রকাশ করেছে ভারত। ওই তালিকা প্রকাশের পর নাগরিকত্ব হারিয়েছে আসামের ১৯ লাখ মানুষ। এই ১৯ লাখ লোককে ভারত থেকে বের করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে মোদি সরকার। তারা যদি ভারত ছাড়তে বাধ্য হয় তাহলে গন্তব্য হবে বাংলাদেশ। এরপর, গত সপ্তাহে নাগরিক সংশোধনী বিল পাস করেছে মোদি সরকার। এই আইন বাস্তবায়ন হলে আসামের ১৯ লাখের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয়ের যোগ হবে আরও কমপক্ষে ২০ লাখ লোক। সব মিলিয়ে ৪০ লাখ ভারত ছেড়ে বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
শেখ হাসিনার মন্ত্রীরা মুখ দিয়ে এনআরসি ও সিএবিকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বললেও ভেতরে চরম অস্বস্তিতে রয়েছে। এসব নিয়ে মোদির সঙ্গে এখন শেখ হাসিনার সম্পর্ক চরম অবনতির দিকে। আকাশ ছোয়া সম্পর্ক যেকোনো সময় মাটিতে ধপাস করে পড়ে যেতে পারে। সর্বশেষ এটার প্রতিফলন দেখা গেছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ভারত সফর বাতিলের মধ্যদিয়ে।
গত বৃহস্পতিবার ইন্ডিয়ান ওশান ডায়ালগে যোগ দিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মেঘালয়ের রাজ্যের আমান্ত্রণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বুধবার তাদের সফর বাতিল করা হয়। এনআরসি নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে দুইমন্ত্রীর সফর বাতিল এমন সংবাদ প্রকাশের পর আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পরের দিন ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, সামনে বিজয় দিবস থাকায় আপাতত দুইমন্ত্রীর সফর স্থগিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে তাদের সফর হবে। শনিবার শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামও বলেছেন-এনআরসির সঙ্গে দুইমন্ত্রীর সফর বাতিলের কোনো সম্পর্ক নেই।
অপরদিকে, দুইমন্ত্রী সফর বাতিল করায় শেখ হাসিনাকে বাহবা দিচ্ছেন তথাকথিত সুশীলরা। তারা বলছেন-দুইমন্ত্রীর সফর বাতিলের মধ্যদিয়ে শেখ হাসিনা ভারতকে একটা কড়া বার্তা দিয়েছে।
এখন কথা হলো-সরকারের মন্ত্রী ও সুশীল বাবুরা যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তা কি আসলে সঠিক? দুইমন্ত্রীর সফর কি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বাতিল করা হয়েছে নাকি ভারতের পক্ষ থেকে অনীহা প্রকাশ করা হয়েছে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের বিশ্বস্ত একটি সূত্রে জানা গেছে, ভারতের অনীহার কারণেই দুইমন্ত্রীর সফর বাতিল করা হয়েছে। আর দুইমন্ত্রীর সফরে ভারতের অনীহা প্রকাশের মূল কারণ হলো-এনআরসি ও সিএবি।
ভারতের রাজ্যসভায় নাগরিক সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে দুইমন্ত্রী সফরে গিয়ে এনআরসি ও সিএবি নিয়ে কথা বলবে। এজন্য দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে আলোচনার সিডিউল চাওয়া হয়েছে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে। কিন্তু ভারত সরকার সরাসরি এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। ভারত সরকার বলেছে-এনআরসি ও সিএবি নিয়ে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি নয়। আর আপাতত বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রীদের সফরের প্রতিও আগ্রহী নয় নরেন্দ্র মোদির প্রশাসন।
সূত্রটি বলছে, ভারতের এই মনোভাবের কথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গণভবনে পৌছার পরই তাৎক্ষণিক দুইমন্ত্রীর সফর বাতিলের ঘোষণা দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু, পরের দিন ওবায়দুল কাদের দুইমন্ত্রীর সফর বাতিল নিয়ে দেশবাসীকে গুজা মিলের একটা ব্যাখ্যা শুনালেন। এটা অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো।
রাজনীতিক বিশ্লেষকসহ সচেতন মহল বলছেন, ভারতের সঙ্গে হাসিনার সম্পর্ক এখন একেবারে তলানীতে। অনেক কষ্ট করে শেখ হাসিনা বিষয়টিকে চেপে যাচ্ছেন। কারণ, এটা প্রকাশ হলে শেখ হাসিনার সরকার বড় ধরণের রাজনৈতিক সংকটে পড়ে যাবে। ভারত মুখ ফিরিয়ে নেয়া মানে শেক হাসিনা ক্ষমতার শেষ প্রান্তে। শেখ হাসিনা এখন উভয় সংকটে পড়েছেন। ভারতের আচরণ সহ্যও করতে পারছেন না, আবার মুখ খুলে বলতেও পারছেন না।
এছাড়া ভারতের গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশ–ভারতের সম্পর্ককে ‘সোনালি অধ্যায়’ হিসেবে নেতারা বর্ণনা করলেও ভারতীয় পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল নিয়ে তীব্র বিতর্কের পর ঢাকার পক্ষ থেকে অস্বস্তি আরও বাড়বে—এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। রাজ্য সভায় ওই বিল পাস করার আগেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর মন্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ভারতের লোকসভায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে অমিত শাহের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে না। বরং তাঁরা শান্তি এবং সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছেন।
কিন্তু ঘটনার গতি থেকে স্পষ্ট যে বাংলাদেশের অসন্তোষ গভীরে। গত কাল রাতে সিএবি পাশ হওয়ার পর এই মোমেনই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ভারতের নিজের দেশে অনেক সমস্যা রয়েছে। ওরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করুক, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। বন্ধু দেশ হিসাবে আমরা আশা করছি ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘বাংলাদেশের মতো খুব কম দেশই রয়েছে যেখানে এত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রয়েছে। উনি (অমিত শাহ) আমাদের দেশে কয়েক মাস থাকলেই দেখতে পাবেন, এখানকার সম্প্রীতি নজির হতে পারে।’’ সূত্র বলছে, বিল পাশের সময় যে ভাবে বার বার পাকিস্তানের সঙ্গে একই বন্ধনীতে বাংলাদেশকে রেখে সংখ্যালঘু নিপীড়নের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীর সফরে তাকে (হাসিনা) অভ্যর্থনা জানাতে একজন মন্ত্রীও পাঠাননি মোদি! তা সরকারের জন্য বিড়ম্বনার।